একটি দুটি নয়, নিজের হাতে ৯৩টি খুন করেছিলেন এক ব্যক্তি। আর সেইসব খুনের নেপথ্যে ছিল এক আশ্চর্য কারণ। কোন সূত্রে জুড়ে ছিল এতগুলি হত্যাকাণ্ড? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
তখন স্কুলের নিচু ক্লাসে পড়ছে কিশোরটি। চোখের সামনে যৌন নির্যাতনের শিকার হতে দেখেছিল এক সহপাঠিনী তথা বান্ধবীকে। তাও খোদ শিক্ষকের হাতে। প্রবল আক্রোশে জ্বলেপুড়ে যেতে যেতে তার মনে হয়েছিল, যদি একটা অস্ত্র থাকত হাতে…।
আরও শুনুন: কিশোরীদের রক্তে স্নান, ৬০০ জনকে খুন, কুখ্যাত মহিলা সিরিয়াল কিলারের রুদ্ধশ্বাস গল্প
না, সেদিন আদৌ ওই শিক্ষককে খুন করতে চায়নি সেই কিশোর। বরং সে চেয়েছিল তার কিশোরী বান্ধবীটির হৃৎপিণ্ডের লাবডুব এক লহমায় থামিয়ে দিতে। যাতে আর কোনও দিন এমন কোনও নোংরা হাতের নিষ্পেষণে তাকে পড়তে না হয়। হ্যাঁ, ঠিক সেদিন থেকেই খুন করার ইচ্ছেটা একটু একটু করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল ছোট্ট স্যামুয়েলের মনের মধ্যে। অথচ কোনও অপরাধীকে নয়, অপরাধের শিকারকেই সে সরিয়ে দিতে চেয়েছিল এই দুনিয়া থেকে। আসলে, দুঃখ, হতাশা, খারাপ লাগার হাত থেকেই মুক্তি দিতে চেয়েছিল তাকে।
ঠিক এই গোপন আকাঙ্ক্ষা বুকে নিয়েই একদিন শুরু হয়েছিল তার হত্যালীলা। ঠিক কত মানুষকে যে খুন করেছিল, তা নিজেই ঠিক হিসেব করে উঠতে পারেনি এই সিরিয়াল কিলার। কারণ কোনও আক্রোশ কিংবা মানসিক অসংগতি, এমন ব্যক্তিগত কারণ ছিল না তার এতগুলি খুনের নেপথ্যে। বরং যা ছিল, তাকে বলা যেতে পারে এক সামাজিক ব্রত। দুনিয়া থেকে হতাশা, দুঃখ, মুছে দিতে হবে- স্রেফ এই লক্ষ্য নিয়েই একের পর এক খুন করে গিয়েছিল আমেরিকার কুখ্যাত সিরিয়াল কিলার স্যামুয়েল লিটল। আর তার জেরেই যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে তাবত সিরিয়াল কিলারদের সর্বকালীন রেকর্ড গিয়েছিল ভেঙে।
আরও শুনুন: পুলিশের ঘুম ছুটিয়েছিল কলকাতার প্রথম মহিলা সিরিয়াল কিলার
প্রথম খুনটা ঘটে গিয়েছিল ১৯৭১ সালের এক রাত্রে। আমেরিকার মায়ামি শহরের উজ্জ্বল আলোয় ঝকঝকে এক নাইটক্লাবের মধ্যে থেকেই এক ক্লান্ত যুবতীকে খুঁজে নিয়েছিল স্যামুয়েলের সন্ধানী চোখ। একটু কথা চালাচালির পরেই বছর বত্রিশের তরুণী উজাড় করে দিয়েছিলেন তাঁর মনের কথা। পরিবার বলতে কেউ নেই তাঁর, সম্পর্ক ভাঙছে, কর্মক্ষেত্রেও টালমাটাল দশা, সব মিলিয়ে হতাশার অন্ধকারে একটু একটু করে তলিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। মন দিয়ে তরুণীর কথা শুনছিলেন স্যামুয়েল, আর তার মাথার মধ্যে খেলা করে যাচ্ছিল অন্য আরেক ছক। এমন দুঃসহ জীবন থেকে কি মুক্তি দেওয়া যায় না এই মেয়েটিকে? ভাবনামতোই নিজের গাড়িতে তাকে লিফট দেওয়ার প্রস্তাব দিল স্যামুয়েল। এক নির্জন জায়গায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে যখন দুজনে অলস কথাবার্তায় মগ্ন, স্যামুয়েলের ডান হাতে উঠে এল লোহার চেন। অতর্কিতে তা পাক দিয়ে ধরল তরুণীর গলা। মুহূর্তের ছটফট, তারপর… চিরতরে মুক্তি পেয়ে গেলেন মেরি ব্রসলে।
সেই শুরু। তারপর কেটে গেছে চারটি দশক। ততদিনে আমেরিকার ১৯টি রাজ্য জুড়ে অন্তত ৯৩টি খুন করে ফেলেছে স্যামুয়েল লিটল। অবশেষে ২০১২ সালে একটি খুনের পর প্রথমবারের জন্য তাকে চিহ্নিত করতে পারল পুলিশ, স্যামুয়েলের বয়স যখন ৭২। যদিও ওই একটি খুন ছাড়া, অন্য কোনও খুনের প্রমাণ দূরে থাক, সম্ভাবনার কথাও জানা ছিল না পুলিশের। এমন নিখুঁতভাবেই সিরিয়াল কিলিং করে গিয়েছিল ওই ব্যক্তি। কে জানে, এই দীর্ঘ গোপনীয়তার ভার তাকে ভেতরে ভেতরে ক্লান্ত করে তুলেছিল কি না। হয়তো সেই কারণেই, দুবছর ধরে ৭০০ ঘণ্টারও বেশি জেরা চালিয়ে পুলিশ যা উদ্ধার করতে পারেনি, একসময় নিজেই সেই রহস্য ফাঁস করে দেয় স্যামুয়েল লিটল। পুলিশি নথিতে এতদিন ধরে ‘আনসলভড মিস্ট্রি’-র তকমা পাওয়া প্রায় শ-খানেক খুনের ঘটনায় যবনিকা উঠল এতদিনে।
আসলে স্যামুয়েল নিজেও যে ছিল অবাঞ্ছিত। শ্বেতাঙ্গ মায়ের কৃষ্ণাঙ্গ সন্তান, তাও কুমারী অবস্থার। মা-বাবার সান্নিধ্য মেলেনি, কার্যত অনাথ হিসেবে বড় হয়ে উঠেছিল। তার মতোই যাঁরা কোনও না কোনওভাবে সমাজে অপাংক্তেয় হয়ে রয়েছেন, তাঁদের দুঃখ হতাশা যন্ত্রণাকে নিজের বলেই ভাবতেন স্যামুয়েল। তার ভিকটিমদের মধ্যে একদিকে ছিলেন যৌনকর্মী, গৃহহীন, মাদকাসক্তদের মতো সমাজের পিছিয়ে থাকা বর্গের মানুষেরা; আরেকদিকে ছিলেন মেরির মতো হতাশ, একলা হয়ে যাওয়া কেউ কেউ। আর এই সব মানুষকেই দুঃখের হাত থেকে মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন স্যামুয়েল লিটল। সিরিয়াল কিলার নয়, আসলে সেভিয়ার হয়ে উঠতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু মৃত্যু ছাড়া মুক্তির অন্য কোনও উপায় যে জানাই ছিল না তার। এই সিরিয়াল কিলারের গল্প তাই শেষমেশ চমকেই দেয় বিশ্ববাসীকে। তাকে অপরাধী বলা হবে নাকি হবে না, সে ধন্দ থেকেই যায়।