৭৫ বছর আগে এক দেশ ভেঙে তৈরি হয়েছিল দুই দেশ। দিন গড়ালেও মিলিয়ে যায়নি সেই ভাঙনের দাগ। উপরন্তু ভারত আর পাকিস্তান, দুই দেশের মধ্যে স্থায়ী হয়ে গিয়েছে এক শত্রুভাবাপন্ন মনোভাব। কিন্তু এই পরিস্থিতিতেই জানা যাচ্ছে, ভারতীয় নাগরিকদের মধ্যে পাকিস্তানের নাগরিকত্ব নেওয়ার হার বাড়ছে ক্রমশ। কী কারণ রয়েছে এর নেপথ্যে? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
জন্মসূত্রে এক দেশের নাগরিক হলেও, পরবর্তীকালে অন্য কোনও দেশের নাগরিক হওয়ার মতো ঘটনা বিরল নয়। কখনও কাজের সূত্রে, কখনও বৈবাহিক সম্পর্কের সূত্র ধরে, কখনও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের টানে অন্য দেশে পাড়ি জমান অনেকেই। বিশেষ করে ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশ থেকে প্রথম বিশ্বের ধনী দেশগুলিতে গিয়ে অনেকেই পাকাপাকিভাবে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বেরই আরেকটি দেশে গিয়ে স্থায়ী বসত গড়া? উঁহু, এমনটা বিশেষ শোনা যায় না। কিন্তু সেই ধারণাকেই বদলে দিচ্ছে সাম্প্রতিক ছবিটা। জানা যাচ্ছে, ভারতীয় নাগরিকদের মধ্যে পাকিস্তানের নাগরিকত্ব নেওয়ার হার বাড়ছে ক্রমশ। সম্প্রতি প্রকাশিত এক সরকারি সমীক্ষা জানিয়েছে, বিগত দুবছরে এই হার ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী, যা রীতিমতো উদ্বেগের। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ২০১৯ সালে কোনও ভারতীয় নাগরিকই পাকিস্তানের নাগরিকত্ব নেননি। কিন্তু ২০২০ সালে এই পথে পা বাড়িয়েছেন ৭ জন ভারতীয়। আর ২০২১ সালে সেই সংখ্যাটাই একলাফে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪১। অর্থাৎ আক্ষরিক অর্থেই লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে এই হার।
আরও শুনুন: জ্ঞানের পথে বাধা নয় ধর্ম, রামায়ণ নিয়ে কুইজে সেরার খেতাব দুই মুসলিম পড়ুয়ার
একে তো এই দুই পড়শি দেশের মধ্যে এক চিরস্থায়ী শত্রুতা জারি রয়েছে, তার উপরে অর্থনৈতিক ভাবেও পাকিস্তানের অবস্থা আদৌ ভারতের চেয়ে ভাল নয়। এমনকি রাজনৈতিক ভাবেও খানিক টালমাটাল সে দেশ। এহেন পরিস্থিতিতে কেন ভারত থেকে পাকিস্তানে গিয়ে স্থায়ীভাবে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন অনেকেই? তবে কি এর নেপথ্যে রয়েছে কোনও গূঢ় কারণ? নাকি কোনও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত দিচ্ছে এই ঘটনা?
আরও শুনুন: রক্ষা করেন স্বয়ং মহেশ্বর, পালিয়ে বিয়ে করা যুগলদের আশ্রয় দেয় দেশের এই মন্দির
সেই প্রশ্নেরই উত্তর দিয়েছেন ৩৪ বছরের পদ্মিনী রাঠোর, সম্প্রতি ভারতের নাগরিকত্ব ছেড়ে যিনি খাতায় কলমে পাকিস্তানের নাগরিক হয়েছেন। কেন এমনটা করলেন তিনি, এর উত্তরে পদ্মিনী জানিয়েছেন, এ কাজ করতে কার্যত বাধ্য হয়েছেন তিনি। ২০১৫ সালে রাজস্থানের কানোটার রাজপরিবারের মেয়ে পদ্মিনীর বিয়ে হয় পাকিস্তানের সিন্ধের অমরকোট রাজপরিবারের ছেলে কুনওয়ার কর্ণী সিং সোধা-র সঙ্গে। কিন্তু যুযুধান সীমান্তের দুই প্রান্তে থাকা দুজন মানুষের পক্ষে সংসার যাপন করা যে কী সমস্যার, প্রতিনিয়ত তা উপলব্ধি করেছেন পদ্মিনী। তাঁদের পাঁচ বছরের সন্তান জন্মসূত্রেই পাকিস্তানি পাসপোর্ট পেয়েছে। গোটা পরিবারে একমাত্র পদ্মিনীই ভারতীয় নাগরিক ছিলেন। কিন্তু এর জেরে তাঁর পাকিস্তানে যাওয়াটাই বারবার সমস্যার মুখে পড়ত। আগে বছরে চারবার পাকিস্তানে যাওয়ার সুবিধা পেলেও, ২০১৯ সালে পুলওয়ামা হামলার পর বছরে মাত্র দুবার পাকিস্তানে যেতে পারতেন পদ্মিনী। পাকিস্তানে কোনও জমি কেনা, এমনকি ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট খোলাও তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। পাকিস্তানের এক শহর থেকে আরেক শহরে যেতেও প্রয়োজন হত ভিসার। আবার পাকিস্তান থেকে কারও ভারতে আসার অনুমতি পাওয়াও সহজ নয় বলেই জানিয়েছেন তিনি। এইসব সমস্যা এড়ানোর জন্যই তাঁর মতো অনেকে পাকিস্তানের নাগরিকত্ব নিতে বাধ্য হন বলে মনে করেন তিনি। কারণ কোনও ভারতীয় একইসঙ্গে দুই দেশের নাগরিকত্ব বজায় রাখতে পারেন না। এদিকে পাকিস্তানের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করলেও তা পেতে তাঁকে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে বলে জানিয়েছেন পদ্মিনী। পুলওয়ামা হামলা, বালাকোট স্ট্রাইক, জম্মু-কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারার অবলুপ্তির মতো একাধিক কারণে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে, আর তার জেরেই এই দেরি, এমনটাই ধারণা পদ্মিনীর।
যদিও ভারতের প্রাক্তন পররাষ্ট্রসচিব কানওয়াল সিবল নাগরিকত্ব বদলের এই ঊর্ধ্বমুখী হারকে গুরুত্ব দিতে নারাজ। জমে থাকা একাধিক আবেদন মঞ্জুর করার কারণেই বেড়েছে এই হার- এমনটাই মনে করেন প্রাক্তন পররাষ্ট্রসচিব।