১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট। এক ভয়ংকর বোমা বিস্ফোরণে পৃথিবী থেকে মুছে গিয়েছিল হিরোশিমা নামের একটা শহর। চোখের নিমেষে প্রাণ হারিয়েছিল লক্ষ লক্ষ মানুষ। আর যারা বেঁচে ছিল, তাদের মধ্যেও চিরস্থায়ী ছাপ রেখে গিয়েছিল সেই পারমাণবিক বোমা। তাদেরই একজন, একটি বারো বছরের মেয়ে, মরতে মরতেও লিখে গিয়েছিল বেঁচে থাকবার এক অপূর্ব রূপকথা। নিজের জীবন দিয়ে সে লিখেছিল যুদ্ধবিরোধী ইস্তেহার। আসুন, শুনে নেওয়া যাক তার কথা।
দশ বছর আগের সেই দিনটার কথা প্রায় মনেই নেই ছোট্ট মেয়েটির। তখন সে আরও ছোট, বয়স দুবছরও পেরোয়নি তার। সেই সময়েই একদিন নাকি আচমকাই আকাশ জুড়ে ঝলসে উঠেছিল লক্ষ আতশবাজি। আর লক্ষ কোটি শব্দবাজির আওয়াজ যেন ফাটিয়ে দিয়েছিল কানের পর্দা। সে বড় হয়ে জেনেছে, সেই আশ্চর্য দৃশ্যের ভিতরেই সেদিন চিরঘুমে ঢলে পড়েছিল অসংখ্য মানুষ। কারণ কোনও আতশবাজি নয়, আসলে ভয়ংকর এক বোমা সেদিন আক্ষরিক অর্থেই আকাশ থেকে নেমে এসেছিল। ছ-বছর ধরে চলতে থাকা যুদ্ধে সেদিন ওস্তাদের মার দিয়েছিল আমেরিকা। দীর্ঘ গবেষণার পর আবিষ্কার করা পারমাণবিক বোমার শক্তি পরখ করার জন্য শত্রুদেশ জাপানের এই শহরটিকেই বেছে নিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মায়ের কাছ থেকে, বাবার কাছ থেকে সেদিনের গল্প বারবার শুনেছে সাদাকো নামের সেই মেয়েটি। ভাগ্যক্রমে, তার পরিবার অক্ষতই ছিল সেদিন। অন্তত সেই অভিশপ্ত রাতে তেমনটাই ভেবেছিলেন তার মা বাবা। কারণ, সেই প্রচণ্ড বিস্ফোরণের অভিঘাতে যখন জানলার বাইরে ছিটকে পড়েছিল সেদিনের ছোট্ট মেয়েটি, দিশাহারার মতো ছুটে গিয়েছিলেন মা। ধরেই নিয়েছিলেন, মেয়ের মৃতদেহই কুড়িয়ে আনতে হবে তাঁকে। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, মেয়ের কাছে পৌঁছে তিনি দেখেছিলেন তার গায়ে আঁচড়টুকু লাগেনি। অথচ… তা যে কতখানি মরীচিকা ছিল, কে জানত সে কথা! ডাক্তারের মতে, সেই অভিশপ্ত দিনেই নাকি সাদাকোর শরীরে ঢুকে যায় অসুখের বীজ। বহুকাল ঘুমিয়ে ছিল। এতদিনে সে জানান দিয়েছে নিজের অস্তিত্ব।
আরও শুনুন: কবে ভক্তদের জন্য খুলবে রাম মন্দির? ভূমিপূজার দ্বিতীয় বার্ষিকীতে জানাল ট্রাস্ট
হ্যাঁ, অ্যাকিউট ম্যালিগন্যান্ট লিম্ফ গ্ল্যান্ড লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিল সাদাকো সাসাকি নামের সেই জাপানি মেয়েটি। জাপানের বাসিন্দাদের কাছে সেইসময় এর পরিচিতি ছিল ‘অ্যাটমিক বম্ব ডিজিজ’ নামে। ১৯৪৫ এর ৬ আগস্ট ‘লিটল বয়’-এর বিস্ফোরণ কেবল অগণিত মানুষের প্রাণ ছিনিয়ে নেয়নি, তেজস্ক্রিয় বিকিরণে অসংখ্য মানুষের দেহ তাদের অজান্তেই হয়ে উঠেছিল মারণরোগের কূপ। তছনছ হয়েছিল কত শিশুর আগামী জীবন। সাদাকো সাসাকি তাদেরই একজন। মাত্র বারো বছরেই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিতে হয়েছিল যাকে। কিন্তু মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও বেঁচে থাকার লড়াই থেকে এক পা পিছু হটেনি সেই কিশোরী। জাপানের গল্পকথা বলে, কেউ যদি হাজারটা কাগজের সারস বানাতে পারে, তাহলে নাকি তার যে কোনও ইচ্ছে পূর্ণ হয়। বাবার কাছে একদিন এই গল্প শুনে সাদাকো ভেবেছিল, হাজারটা সারস বানাতে পারলে ভাল হয়ে উঠবে সেও। তাই রোগশয্যায় শুয়ে শুয়েও অবিরাম কাগজ দিয়ে সারস বানাতে থাকে সাদাকো। এদিকে যুদ্ধের পর জাপানে কাগজেরও আকাল। কিন্তু সাদাকোর এই ইচ্ছেকে ভালবেসে হাসপাতালে তাকে কাগজ, ওষুধের স্ট্রিপ, উপহারের র্যাপার জোগান দিয়ে যেত তার বন্ধুরা, এমনকি নার্সরাও।
আরও শুনুন: প্রত্যেক জেলায় হোক ‘সংস্কৃত গ্রাম’, অভিনব উদ্যোগ উত্তরাখণ্ডের
সাদাকোকে নিয়ে লেখা উপন্যাস ‘সাদাকো অ্যান্ড দ্য থাউজ্যান্ড পেপার ক্রেনস’ জানিয়েছিল, হাজারটা সারস বানিয়ে ওঠার আগেই জীবন থেকে ছুটির পরোয়ানা এসে গিয়েছিল তার। কিন্তু বাস্তবে তার দাদা জানিয়েছেন, সহজে হাল ছাড়ার মেয়ে ছিল না সাদাকো। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েই ১৯৫৫-র আগস্ট নাগাদ এক হাজার সারস তৈরি করে ফেলেছিল সে। যদিও তাকে রোখা যায়নি মৃত্যুকে। কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে শান্তির প্রতীক হয়ে উঠেছিল এই কিশোরী। হিরোশিমা পিস মেমোরিয়াল পার্কে তাই আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে সোনার সারস হাতে সাদাকোর মূর্তি। তলায় লেখা, “এই আমাদের কান্না। এই আমাদের প্রার্থনা। পৃথিবীতে শান্তি আসুক।” না, পৃথিবীতে যুদ্ধ-হিংসা-মৃত্যু থামেনি তারপরেও। কিন্তু সব অন্ধকারের সামনে দাঁড়িয়েও যে জীবনের গল্প বলা যায়, সে কথাই যেন শিখিয়ে যায় এই হারিয়ে যাওয়া মেয়েটি।