খোদ আমেরিকার বুকেই রয়েছে এমন একটি রাস্তা, যার নামকরণ করা হয়েছে এক সাধারণ ভারতীয় গৃহবধূর নামে। ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলে অঞ্চলের মতো অভিজাত এলাকায় রয়েছে সেই কালা বাগাই রোড। কিন্তু কে এই কালা বাগাই, জানেন কি? কেনই বা তাঁর নামে একটি গোটা রাস্তার নামকরণ করল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
আমেরিকায় আসা প্রথম দিকের দক্ষিণ এশীয় মহিলাদের মধ্যে তিনিও একজন। স্বামীর হাত ধরে, সন্তান কোলে নিয়ে পা রেখেছিলেন সাত সাগর পারের এই স্বপ্নরাজ্যে। ভাগ্যের খোঁজে যেমন ভিনদেশে পাড়ি দেয় মানুষ। কিন্তু সেই অচেনা দেশ তাঁদের আপন করে নেয়নি। বরং এই কালো রঙের মানুষদের দিকে ছুঁড়ে দিয়েছিল তীব্র অপমান বিদ্বেষ আর ঘৃণা। তবুও হার মানেননি এই সাধারণ গৃহবধূ। নিজের জন্য, পাশাপাশি নিজের মতো উদ্বাস্তু আর কালো মানুষদের জন্য আজীবন লড়াই করে গিয়েছেন তিনি। আর লড়াইয়ের সূত্রেই সেই সম্মান অর্জন করে নিয়েছিলেন কালা বাগাই, যা তাঁর প্রাপ্য ছিল।
আরও শুনুন: গৃহহিংসা থেকে বাঁচিয়েছিল সন্ন্যাস, অন্য মেয়েদের বাঁচার পথ দেখাচ্ছেন এই ‘রকস্টার’ সন্ন্যাসিনী
ঠিক কী করেছিলেন কালা বাগাই?
স্বামী বৈষ্ণোদাস বাগাই-এর সঙ্গে পরাধীন ভারত থেকে আমেরিকায় এসে পৌঁছেছিলেন কালা বাগাই। সেটা ১৯১৫ সাল। সাদা চামড়ার শাসন কেমন হয় তাঁরা দেখেছিলেন, কিন্তু আমেরিকাতেও সেই সাদা-কালোর ভেদাভেদ যে কতটা জারি রয়েছে তা জানতেন না বাগাই দম্পতি। সানফ্রান্সিস্কো এলাকায় কিছুদিন কাটানোর পর মাথা গোঁজার জন্য বার্কলে অঞ্চলে একটি বাড়ি কিনেছিলেন তাঁরা। বাড়ির আগের মালিক ছিলেন এক সাহেব। শ্বেতাঙ্গ অধ্যুষিত এলাকায় অবস্থিত সেই বাড়িতে নাকি থাকবে কালা নেটিভেরা? কোমর বেঁধে রুখে দাঁড়ালেন সাদা চামড়ার প্রতিবেশীরা। নিজেদের কেনা বাড়িতে ঢুকতেই পারল না বাগাই পরিবার। উপরন্তু কপালে জুটল রীতিমতো শারীরিক হেনস্তা। সেদিন একরকম পালিয়েই প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন তাঁরা।
কিন্তু পালিয়ে থাকার লোক ছিলেন না কালা বাগাই। এই আপাত সাধারণ গৃহবধূর মধ্যে ছিল অদম্য জেদ। তিনি বুঝেছিলেন এই বিদ্বেষের সঙ্গে একা লড়া যাবে না। ফের সানফ্রান্সিস্কোতে ফিরে আমেরিকার বুকে এশীয় কমিউনিটি গড়ে তোলার উদ্যোগ নিলেন তিনি। পাশাপাশি তালিম নিতে শুরু করলেন ইংরেজি ভাষায়, শিখতে লাগলেন সে দেশের আদবকায়দাও। এদিকে গদর পার্টির সঙ্গে যুক্ত স্বামীর সঙ্গে মিলে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনেও সহযোগিতা করতেন কালা বাগাই।
আরও শুনুন: মেয়ের নাম দ্রৌপদী রাখেন না অভিভাবকরা! রাষ্ট্রপতি কি বদলে দেবেন ধারণা?
কিন্তু যখন সেই হিংস্রতার স্মৃতি খানিক মিলিয়ে এসেছে, সেই সময়ই আবার আঘাত নেমে এল। আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট এবং অভিবাসন দপ্তর হঠাৎই নাকচ করে দিল প্রবাসী ভারতীয়দের নাগরিকত্ব। কলমের এক খোঁচায় উদ্বাস্তু হয়ে গেলেন কালো চামড়ার সেই মানুষগুলো। নিজেদের ব্যবসাপত্র, বাড়ি, সম্পত্তি সবকিছু বিক্রি করে ফেলা ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না বাগাই পরিবারের। বিদেশ-বিভুঁইয়ে এসে শূন্য থেকে শুরু করে যা কিছু অর্জন করেছিলেন, সব খুইয়ে ফের পথে এসে দাঁড়াতে হল তাঁদের। হতাশায় আত্মঘাতী হলেন বৈষ্ণোদাস বাগাই। কিন্তু অদ্ভুত মনের জোর কালা বাগাইয়ের। সেই পরিস্থিতিতেও হাল ছাড়লেন না তিনি। একা হাতেই বড় করে তুললেন তিন সন্তানকে।
পরে গদর দলের আরেক সদস্য মহেশ চন্দ্রকে বিয়ে করেন কালা বাগাই। নাইট স্কুলে পড়াশোনা চালান, শিখে নেন ইংরেজি ভাষা, এমনকি টেনিস খেলা- আধুনিকা পোশাক পরা ইত্যাদি আদবকায়দাও। আর সবের মধ্যেই জারি ছিল তাঁর কমিউনিটি তৈরির কাজ। বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে, সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার জন্য সেই বিদেশে অক্লান্ত লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন তিনি। লড়াই করেছেন দক্ষিণ এশিয়া থেকে আসা পরিযায়ী মানুষদের অধিকারের দাবিতে। অবশেষে মার্কিন নাগরিকত্বও অর্জন করেন কালা বাগাই। আর যে শহর একদিন তাঁকে নিজের বাড়িতে ঢোকার অধিকার দেয়নি, সেই শহরেরই একটি রাস্তার নাম হয় তাঁর নামে, ‘কালা বাগাই রোড’। কালা বাগাই-এর মতো কালো মানুষদের লড়াইয়ে এ যেন এক মাইলস্টোন।