তিনি বাঙালির আইকন। বাঙালির আবেগ, ভালোবাসা, স্বপ্ন। তিনি তো ক্রিকেটার মাত্র নন, প্রজন্মের ইশতেহার; সময়ের জোরালো স্টেটমেন্ট। তিনি যতখানি আন্তর্জাতিক, ততখানিই সর্বভারতীয় আবার একই সঙ্গে প্রোজ্জ্বল নিপাট বাঙালিয়ানাতেও। কয়েক প্রজন্ম ধরে যে-সৌরভে মাতোয়ারা বাংলা ও বাঙালি, মহারাজকীয় আভিজাত্যেই জীবনের বাইশ গজে অর্ধশতক পূর্ণ করে ফেললেন তিনি। সামনে অমরত্বের পথ, পিছনে কয়েক প্রজন্মের স্মৃতির কোলাজ। সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে নস্ট্যালজিয়ায় ডুব দিলেন কৃশানু মজুমদার।
পাঠ ও আবহ: শঙ্খ বিশ্বাস।
কবি সুবোধ সরকার লিখেছেন,
‘বেহালা কোনও গ্রাম নয়।
বেহালা কোনও উপত্যকা নয়।
বেহালা কোনও শহর নয়।
বেহালা কোনও আঙুরখেত নয়।’…
বেহালা তবে কী?
বেহালা আসলে বাঙালির হৃদস্পন্দনের রাজধানী। বহির্বিশ্বে বাঙালির পরিচয়ের পাসপোর্ট। বেহালার বীরেন রায় রোডের ওই বাড়িটাই যে বাঙালির আবেগের নিউক্লিয়াস। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় নামের মহানায়কের আবির্ভাবের তীর্থ এই বেহালা।
পাকিস্তান হোক বা অস্ট্রেলিয়া, ‘আই অ্যাম ফ্রম দ্য ল্যান্ড অফ সৌরভ গাঙ্গুলি’ বললেই এক লহমায় অপরিচিত হয়ে ওঠেন পরিচিত। হয়ে যান হৃদয়ের খুব কাছাকাছি। সৌরভ নামের মাহাত্ম্যই যে এমন। বেহালা টু আসমুদ্রহিমাচল! সেখান থেকে গোটা বিশ্ব। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের হাত ধরে বাঙালি গর্বের সিংহাসনে আসীন থেকেছে বছরের পর বছর। মহারাজের দীপ্তিতে আলোকিত হয়ে থেকেছে বঙ্গ সমাজ। বারংবার শিরোনাম হয়েছে, ‘মহারাজা তোমারে সেলাম।’ সেই সৌরভ হাফসেঞ্চুরি করে ফেলছেন জীবনের ময়দানে। বিশ্বাস-ই হয়তো হবে না!
নিপাট প্রাণখোলা হাসি, ফর্সা ধবধবে মুখাবয়ব- আভিজাত্যের ককটেলে এখনও বাঙালির গ্লোবাল আইকন তিনি। সময়ের স্রোত বয়ে চলেছে। পেরিয়ে গিয়েছে একের পর এক দশক; সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় তবু যেন আজন্ম কিশোর। আমাদের ঘরের ছেলে। নব্বইয়ের সেই সদ্য গোঁফের রেখা গজানো কিশোরের মতো-ই। একসময়ে হালকা গোঁফের রেখা গজানো কিশোরের সঙ্গে সৌরভের মুখের মিল খুঁজত এই বঙ্গসমাজ। বান্ধবীরা লাজুক হাসি জড়িয়ে বলত, ‘তোকে না ঠিক গাঙ্গুলির মতো দেখতে।’ এই গাঙ্গুলিরা কেউ মেদিনীপুরের, কেউবা বাঁকুড়ার, কেউ আবার পুরুলিয়ার। বেহালার ছেলেটা তখন আন্তর্জাতিক মঞ্চে ‘সৌরভ’ থেকে হয়ে গিয়েছেন ‘গাঙ্গুলি’। বাঙালি গর্ব বোধ করত বাঁ হাতিকে নিয়ে। তাঁকে নিয়ে লেখা হয়েছে কবিতা। কবির কল্পনায় সেই সৌরভ ‘শান্ত কিন্তু রাগী’, ‘স্থির কিন্তু তেজি’, ‘সমাহিত কিন্তু ছটফটে’।
লর্ডসে অভিষেক টেস্টে সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে সেই ছেলেটিই জানান দেয়, ‘আমি এসে গিয়েছি।’ শেষমুহূর্তে সঞ্জয় মঞ্জরেকর নামতে না-পারায় দলে জায়গা হয়ে যায় সৌরভের। তাঁর ‘গাণ্ডীব’ হয়ে ওঠে পিকাসোর তুলি। বাঁ হাতির পেলব কভার ড্রাইভ দেখে গ্যালারি ডেভিড গাওয়ারের সঙ্গে তুলনা শুরু করে দেয়। তারও অনেক পরে বন্ধু রাহুল দ্রাবিড় সগর্বে বলেছিলেন, ‘অন দ্য অফসাইড ফার্স্ট দেয়ার ইজ গড অ্যান্ড দেন দেয়ার ইজ সৌরভ গাঙ্গুলি।’ অফসাইডের ঈশ্বর বললেও একটুও ভুল হবে না।
লর্ডসের অভিষেক টেস্টের আগে অবশ্য অনেক ঝড়ঝাঞ্ঝা বয়ে গিয়েছিল ছেলেটার উপর দিয়ে। ১৯৯২-এর কুখ্যাত অস্ট্রেলিয়া সফরে সুকৌশলে রটিয়ে দেওয়া হয়েছিল, দ্বাদশ ব্যক্তি হিসেবে জল নিয়ে মাঠে যেতে চায়নি ছেলেটা। ওর মানসিকতা ঠিক নেই। শুরুতেই বিসর্জনের রূপরেখা তৈরি করা ছিল। কিন্তু তিনি তো সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। প্রত্যাবর্তনের মহাসম্রাট। তাঁকে দমিয়ে রাখা কি সম্ভব!
সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় মানে উথাল-পাতাল হৃদকম্প নয়। সৌরভ মানে চোখে চোখ রেখে লড়াই, পালটা দেওয়ার ঔদ্ধত্য। সৌরভ মানে ঐতিহ্যের লর্ডসের ব্যালকনি থেকে জামা উড়িয়ে বাঙালির বিজয়কেতন ওড়ানো, স্টিভকে অপেক্ষা করিয়ে রাখার সাহস। সৌরভ বাঙালির কাছে আস্ত একটা প্রবাদ, দেশকে ঐক্যবদ্ধ করার দারুণ এক ক্ষমতা, আঘাতের বদলে প্রত্যাঘাত, বারবার প্রত্যাবর্তন! তাই তো দেশে-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তের মাঠে ব্যাট হাতে তাঁকে দেখলেই একসময়ে ধ্বনিত হতো, ‘মা, দেখ, কী সুন্দর দেখাচ্ছে আমাদের ছেলেটাকে’।
তখন ভারতীয় ক্রিকেটের মাৎস্যন্যায় দশা। অবিশ্বাস, গড়াপেটার বিষাক্ত নিশ্বাসে জেরবার ভারতীয় ক্রিকেট। ঠিক সেই সময়ে ‘নতুন ভারত’ তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সৌরভের উপরে। বাকিটা আজ ইতিহাস। ভারতীয় ক্রিকেটে মুম্বই লবির দাপট চিরকালই ছিল, তা সবারই জানা। কিন্তু সৌরভের ভারতে কোনও লবি ছিল না, ছিল না দলাদলি। একজনই দেশনায়ক। তিনি সৌরভ। সবার দাদা। সৌরভের ছোঁয়ায় ভারতীয় ক্রিকেটের সাজঘরে ছড়াল বিশুদ্ধ বাতাস। দেশের বাইরেও এই ভারত এক মহাশক্তি। যা একসময়ে ছিল কল্পমায়া। প্রয়াত নেলসন ম্যান্ডেলার দেশে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপের ফাইনালে পৌঁছল সৌরভের ভারত। কুড়ি বছর বাদে বিশ্বচ্যাম্পিয়নের তাজ মাথায় পরার দারুণ এক সুযোগ। সেই কবে ১৯৮৩ সালে কপিলদেব নিখাঞ্জের ভারত লর্ডসে শুনিয়েছিল জন-গণ-মন। তার পরে বিশ্বকাপ আর ঘরে আসেনি। সেদিন বেহালার ছেলেটার দিকেই তাকিয়েছিল গোটা দেশ। কিন্তু শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়া স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছিল সৌরভের। এরকম স্বপ্ন তো কতই ভাঙে। কিন্তু স্বপ্ন দেখা কি ছাড়তে পেরেছিলেন তিনি? নিজে অধিনায়ক হিসেবে বিশ্বকাপ জিততে না পারলেও তাঁর হাতে তৈরি ভারতই পরে ফুল ফুটিয়েছিল বিশ্বকাপে। যে রাজ্যপাট একদিন গড়ে তুলেছিলেন মহারাজ, সেই সাম্রাজ্যের অধীশ্বর করা হয়েছিল মহেন্দ্র সিং ধোনিকে।
দেশীয় ক্রিকেটের রক্তাল্পতা দূর করতে গিয়ে কতবারই না রক্তাক্ত হতে হয়েছে সৌরভকে। কথা রাখেননি অনেকেই। দেশীয় ক্রিকেটের উন্নতির জন্য ধুরন্ধর মস্তিষ্কের অধিকারী গুরু গ্রেগকে এনেছিলেন। প্রাক্তন অজি কিংবদন্তি হতেই পারতেন ‘চাণক্য’। কিন্তু কোচের চেয়ারে বসে গুরু গ্রেগ অধিনায়ক সৌরভকেই ছেঁটে ফেললেন। সে এক ভয়ংকর পরিস্থিতি ভারতীয় ক্রিকেটে। দেশ ফুটছে। মহারাজের অসম্মান মেনে নিতে পারেননি কেউ। গ্রেগের কুশপুত্তলিকা পুড়েছে, শাপশাপান্ত করা হয়েছে তাঁকে, দেশের মাঠেই সমর্থন হারিয়েছে জাতীয় দল। আবেগের ইডেন গার্ডেন্সে তা পৌঁছয় সপ্তমে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে সেই ম্যাচে ইডেনের সমর্থন পায়নি ‘গ্রেগ অ্যান্ড কোং’। অধিনায়ক রাহুল দ্রাবিড় পরে বলেছিলেন, ‘যা ব্যারাকিং হল, মনে হচ্ছিল দেশের বাইরে বুঝি খেলতে নেমেছি।’ ঘরের ছেলেকে অন্যায় ভাবে সরিয়ে দেওয়ায় ক্ষোভে ফুঁসছিল কলকাতার বড় প্রিয়, বড় সাধের ইডেন।
‘বাপি বাড়ি যা’ শটে বহুবার ছক্কা হাঁকিয়েছেন সৌরভ। একটা ছয় দেখার জন্য অপেক্ষায় থাকত গোটা দেশ। ওই ছক্কা গোটা দেশে এঁকে দিত শান্তির ছবি, বড় ক্যানভাসে ফুটে উঠত মিলনান্তক সব দৃশ্য। কবিতায় তেই লেখা হয়, ‘একটা দুরন্ত ছয় মারল ছেলেটা। জ্যোৎস্না পার হয়ে বলটা গিয়ে পড়ল আসামের জঙ্গলে, সেখানে তিনজন টেররিস্ট বসে আছে সাইনাইড খাবে বলে তিনজনই লাফিয়ে উঠল, আঃ মৃত্যু! দাঁড়াও! আর একটা ছয় দেখে যেতে চাই।’…
সব ভাল জিনিস একদিন শেষ হয়। কিন্তু তাই বলে মহাঅষ্টমীর দিন বিসর্জনের রিং টোন শুনিয়ে দেবেন সৌরভ! অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সিরিজ শুরুর আগে বোমা ফাটিয়ে সৌরভ বলে দিলেন, ”আই জাস্ট ওয়ান্ট টু সে দ্যাট দিস ইজ গোয়িং টু বি মাই লাস্ট সিরিজ। আই হ্যাভ ডিসাইডেড টু কুইট।” সেই বিষণ্ণতার রেশ আজও যে রয়ে গিয়েছে। সেই ক্ষতে প্রলেপ পড়েনি এখনও। শিরস্ত্রাণ কেন খুলে রাখলেন প্রিয় মহারাজ, সেই প্রশ্নের উত্তর আজও খোঁজে ক্রিকেট-সমাজ। চায়ের পেয়ালায় তুফান ওঠে।
রবি ঠাকুরের কথায়, ‘জন্মদিন আসে বারে বারে মনে করাবারে…।’ প্রতিবার ৮ জুলাই এলেই রিওয়াইন্ড মোডে চলে যায় বাঙালি। জন্মদিনের স্মরণীয় সব বছরগুলো ভেসে ওঠে দৃশ্যপটে। এই অবকাশে ফিরে দেখা যাক একবার-
১৯৯০ সালের ৮ জুলাই। রঞ্জি ট্রফি জেতার পরেই এসেছিল ১৮ বছরের জন্মদিন।
১৯৯৬ সালের ৮ জুলাই। লর্ডসের অভিষেক টেস্টে সাড়া জাগানো সেঞ্চুরিতে আবির্ভাব ঘোষণার পরবর্তীতে এসেছিল ২৪ বছরের জন্মদিন।
২০০০ সালের ৮ জুলাই। ভারতীয় দলের অধিনায়ক হিসেবে স্মরণীয় ছিল ২৮ বছরের জন্মদিন।
২০১৬ সালের ৮ জুলাই। ৪৪ বছরের জন্মদিন,সিএবি প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথম বার।
২০২০ সালের ৮ জুলাই। ৪৮ বছরের জন্মদিনে বিসিসিআই প্রেসিডেন্টের মুকুট তাঁর মাথায়
২০২২ সালের ৮ জুলাই। ৫০ বছরের জন্মদিনেও তিনি বোর্ড প্রেসিডেন্ট। জনপ্রিয়তার শীর্ষে এখনও তিনিই।
তিনি বিরিয়ানি প্রেমিক, ফুটবল মাঠে এঁকে বেঁকে ডিফেন্স ভাঙতে পারেন, দুর্গাপুজোর মণ্ডপে পাঞ্জাবি-পায়জামা পরে ঢাক বাজান, বিসর্জনেও নাচতেও দ্বিধাগ্রস্ত নন। সৌরভ মানে বিশ্ব দরবারে বাঙালিয়ানার সেই মহীরূহ, যাঁর শিকড় এই বাংলাতেই।