ধর্মের দিক থেকে তাঁরা পৃথক। তবে স্বাধীনতার প্রশ্নে তাঁদের কোনও পার্থক্য নেই। বাংলার ইতিহাসে বীরভূমের রাজনগরের মুসলমান রাজা এবং বিষ্ণুপুরের হিন্দু রাজাদের এই সাদৃশ্য ছিল চোখে পড়ার মতো। বিদেশি আগ্রাসন রুখতে দুই রাজাই লড়াই করেছিলেন নিজের মতো করে। আসুন শুনে যাওয়া যাক, বাংলার সেই গৌরবময় ইতিহাসের কথা।
স্বাধীনতার মর্যাদা এবং জোর যে কতখানি, বাংলার ইতিহাসের দিকে তাকালেই তার নমুনা চোখে পড়ে। এই বাংলা যেমন শাসন করেছেন স্বাধীন হিন্দু রাজারা, তেমন মুসলমান রাজারাও করেছেন রাজত্ব। ইতিহাস ওলটালে দেখা যায়, দুই ধর্মের রাজারাই ছিলেন অত্যন্ত স্বাধীনচেতা। এবং যে কোনও মূল্যে বাংলার স্বাধীনতা রক্ষার জন্য ছিলেন বদ্ধপরিকর। বহিরাগত আগ্রাসন ঠেকাতে তাঁরা নিজেদের মতো করে প্রতিরোধও গড়ে তুলেছিলেন।
আরও শুনুন: হিন্দু রাজার জমিতেই গড়ে উঠেছিল তাজমহল, কীসের বিনিময়ে পেয়েছিলেন শাহজাহান?
মল্লরাজ বীর হাম্বীরের বীরত্বের কথা আমরা জানি। করদ রাজ্য হলেও বিষ্ণুপুরের রাজারা কখনও মাথা হেঁট করেননি। অত্যন্ত স্বাধীনচেতা ছিলেন তাঁরা। রাজ্যের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কারও কোনও হস্তক্ষেপ তাঁরা পছন্দ করতেন না, করতে দিতেনও না। এই রাজবংশের সর্বশ্রেষ্ঠ কাহিনি লিখিত হয়ে আছে সম্ভবত বীর হাম্বিরের গল্পেই। প্রবল পরাক্রমশালী পাঠান সেনাকে রুখে দিয়েছিলেন তিনি। ইতিহাসে কান পাতলে শোনা যায়, দাউদ খাঁ লক্ষাধিক সৈন্য নিয়ে বিষ্ণুপুর আক্রমণ করেছিলেন। বিষ্ণুপুরের যুবরাজ হাম্বীর তখন তাঁর নিজের অপ্রস্তুত সেনাবাহিনীকে সংগঠিত করেন। আরাধ্যা দেবীর উপাসনা করে এগিয়ে যান যুদ্ধে। আশ্চর্য কুশলতায় পাঠান বাহিনীকে তিনি পরাজিত করেছিলেন। বন্দি করেছিলেন দাউদ খাঁকে। বাংলার স্বাধীনতা রক্ষায় সেদিন অমিত পরাক্রম প্রদর্শন করেছিলেন এক হিন্দু রাজা।
আরও শুনুন: রুখে দিয়েছিলেন মহম্মদ ঘোরির জয়রথ, পৃথ্বীরাজই কি ভারতের শেষ হিন্দু শাসক?
আবার একই কাহিনি শোনা যায় রাজনগরের মুসলমান রাজাদের ক্ষেত্রেও। তাঁরাও ছিলেন একইরকম স্বাধীনচেতা। রাজ্যের অভ্যন্তরীণ বিষয় পরিচালনায় কোনও হস্তক্ষেপ তাঁরা গ্রাহ্য করতেন না। বীরভূম ছিল বাংলার মুসলমান শাসকদের অন্যতম প্রধান শাসনকেন্দ্র। সেই মুসলমান রাজারাও বহিরাগত আগ্রাসন রুখতে লড়াই করেছিলেন বিক্রমের সঙ্গেই। ব্রিটিশ ও মারাঠাদের আক্রমণ যখন বাংলার স্বাধীনতা হরণ করতে সক্রিয়, তখন বিদেশি শক্তিকে প্রতিহত করতে পরিকল্পনা করেন বীরভূমের পাঠান রাজারা। তৎকালীন রাজধানী রাজনগরের ৩২ মাইল জুড়ে একটি বাঁধ নির্মাণ করেন তাঁরা। বাঁধের উচ্চতা ছিল অন্তত ১৮ ফুট। আর তার গায়েই কাটা হয় গভীর পরিখা। প্রতিপক্ষ সৈন্যকে বেকায়দায় ফেলতেই ছিল এই ব্যবস্থা। এই ব্যূহের যে দরজা বা ফটক সেখানে থাকত সশস্ত্র প্রহরা। প্রহরীদের বলা হত ঘাটোয়াল। পরবর্তীতে ব্রিটিশ আগ্রাসনে যখন সবকিছু ছারখার হয়ে যায়, তখন এই ঘাটোয়ালরাই ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সময় দেখা দিয়েছিল বিখ্যাত ডাকাতরূপে, অবশ্যই তাঁরা ছিলেন সাধারণ মানুষের পক্ষে। সে অবশ্য আলাদা প্রসঙ্গ।
দুই রাজার বীরগাথা আমাদের এই কথাই জানায় যে, বাংলার গৌরবময় ইতিহাসের দুটি অভিমুখ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এক, এই বাংলা চিরকালই স্বাধীনতাকে সর্বোত্তম মর্যাদা দিয়ে এসেছে। আর দ্বিতীয়ত, ধর্মভেদ থাকা সত্ত্বেও সেই স্বাধীনতা রক্ষায় এই বাংলার হিন্দু ও মুসলমান রাজারা একইরকম বীরের ভূমিকা পালন করেছেন। বহিরাগত আক্রমণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। সমাজতাত্ত্বিক-ঐতিহাসিক বিনয় ঘোষ তাই বলেন, ‘বিষ্ণুপুরের হিন্দু রাজা এবং রাজনগরের মুসলমান রাজা ছিলেন বাংলার স্বাধীন সামন্ত রাজাদের দুই স্তম্ভরূপ। বাংলার সীমান্তে ছিলেন বাংলার স্বাধীনতা রক্ষার দুই পরাক্রমশালী প্রহরী- হিন্দু ও মুসলমান সামন্ত রাজা। কেউ কোনোদিন নিজেদের মধ্যে লড়াই করেননি এবং বিদেশির আক্রমণ দুজনেই প্রতিরোধ করেছেন। … বাংলার ইতিহাসের একটা লুপ্ত অধ্যায়, আজ মনে রূপকথা।’
এ রূপকথা বা ইতিহাস- যাই বলা হোক না কেন- তা যে বাংলার নিজস্ব সম্পদ এবং অর্জন। এই ইতিহাসই আজও আমাদের পথ দেখায়, শেখায় কীভাবে মোকাবিলা করতে হয় সমসাময়িক সংকটকে।