সীতাকে রাবণের কবল থেকে উদ্ধার করতে রামচন্দ্রের জন্য সেতুবন্ধন করেছিল হনুমান। সেই সেতুবন্ধনে যোগ দিয়েছিল অগণিত বানর সেনা। এমনকি বাদ যায়নি খুদে কাঠবিড়ালীও। সেই পৌরাণিক সেতুর অস্তিত্ব নাকি আজও রয়েছে। যদিও সেটিকে ঘিরে বিতর্কের শেষ নেই। কোথায় রয়েছে সেই রামসেতু? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
রামের জন্মস্থান থেকে শুরু করে রাবণের লঙ্কা- আজকের পৃথিবীতে কোথায় রয়েছে সেসবের অস্তিত্ব? তা নিয়ে আগ্রহের শেষ নেই মানুষের। অনেকেই মনে করেন, আজকের শ্রীলঙ্কাই আসলে রামায়ণের সেই লঙ্কারাজ্য। অপহরণের পরে সেখানেই অশোকবনে সীতাকে লুকিয়ে রেখেছিলেন লঙ্কাপতি রাবণ। এমনকী শ্রীলঙ্কাতেও দর্শনীয় স্থান হিসেবে চিহ্নিত করা রয়েছে সেসব জায়গা। তবে এ নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই।
রামজন্মভূমি রয়েছে। রাবণ রাজার দেশও আছে। এত কিছু থাকতে পারলে সমুদ্র পেরোতে রামের জন্য যে সেতু বানিয়ে দিয়েছিল বানর সেনা- তা কি আর নেই! লোকবিশ্বাস বলে, তা-ও আছে। তামিলনাড়ুর পাম্বান আইল্যান্ডের দক্ষিণভাগে অবস্থিত ধনুশকোড়ি থেকে শ্রীলঙ্কার উত্তর-পশ্চিম উপকূলের মান্নার দ্বীপ পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে সেই রামসেতু। অনেকে আবার সেটাকেই বলে আডম’স ব্রিজ। একটি বিশ্বাস অনুসারে অবশ্য, পৃথিবীর প্রথম মানব আদম ইভকে নিয়ে স্বর্গচ্যূত হওয়ার সময় এই সেতু বেঁধেছিল। আর সেই সেতু ধরেই পৃথিবীতে পা পড়েছিল পৃথিবীর প্রথম মানব-মানবীর। তা এই রামসেতু ঘিরেও বিতর্কের শেষ নেই।
আরও শুনুন: রুখে দিয়েছিলেন মহম্মদ ঘোরির জয়রথ, পৃথ্বীরাজই কি ভারতের শেষ হিন্দু শাসক?
অনেকেই মনে করেন, তামিলনাড়ু থেকে শ্রীলঙ্কার পম্বন দ্বীপ পর্যন্ত ৪৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতু আজও রয়েছে। চুনাপাথরের সেই সেতুর অস্তিত্ব মিলেছে নাসার তোলা ছবিতেই। অনেকেই আবার মনে করেন, গোটাটাই আসলে প্রবাল প্রাচীর দিয়ে গঠিত। সমুদ্রের মধ্যে জেগে থাকা সেই দ্বীপ কি আসলে রামায়ণের সেই সেতুই? স্বভাবতই ঘনিয়েছে বিতর্ক।
এই সেতুর কথা প্রথম উল্লেখ করেছিলেন পার্সি ভূতাত্বিক ইবনে খোরদাবেহ। সেটা প্রায় ৮৫০ বছর আগের কথা। তাঁর লেখা ‘বুক অব রোডস অ্যান্ড কিংডমস’ বইতে উল্লেখ ছিল এই বিশেষ সেতুর। ১৮০৪ সালে এক ব্রিটিশ মানচিত্রকার অবশ্য সেটিকে আডম’স ব্রিজ বলেই আখ্যা দিয়েছিলেন। বিভিন্ন ইসলামিক পাঠেও বিষয়টিকে তেমনভাবেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
তামিলনাড়ুর রামেশ্বরম থেকে শ্রীলঙ্কার মাঝখানে জেগে থাকা এই পথ আজও আশ্চর্যজনক। হিন্দু পুরাণ ও মহাকাব্য থেকে জানা যায়, রামের নাম লেখা যে পাথর ফেলে ফেলে বানানো হয়েছিল সেতুটি, সেই পাথর নাকি কখনও ডোবে না। মনে করা হয়, ঠিক তেমন ভাবেই আজও মাঝেমধ্যে ভেসে ওঠে সেই পাথরের দ্বীপ। যদিও তা পুরোটাই ঘটে আবহাওয়ার উপর নির্ভর করে। সমুদ্রের ওই অংশটাও নাকি বেশ অগভীরও। যে কারণে জাহাজ বা বড় নৌকো এড়িয়ে যায় ওই বিশেষ সামুদ্রিক এলাকা।
আরও শুনুন: মন্দির-মসজিদ নিয়ে ফের সরগরম দেশ, এই বিতর্কে কী মত ছিল গান্ধীর?
সেতুটিকে সরাসরি পরীক্ষা না করলেও ইন্ডিয়ান স্পেশ রিসার্চ অর্গানাইজেশনের তথা ইসরোর ‘মেরিন অ্যান্ড ওয়াটার রিসোর্স গ্রুপ অব দ্য স্পেস অ্যাপ্লিকেশন অব ইন্ডিয়া’ উপগ্রহ চিত্রের মাধ্যমে ব্যাপারটি খতিয়ে দেখা শুরু করে। বিস্তর গবেষণার পরে তারা জানায়, সেতুটি আদতে ১০৩টি অংশ বা প্যাচ রিফে বিভক্ত। জিওলজিকাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার গবেষণায় ধরা পড়ে আরও একটি আশ্চর্য তথ্য। সেই তথ্য অনুসারে, রামেশ্বরম দ্বীপ গঠিত হতে শুরু করেছিল প্রায় ১ লক্ষ ২৫ হাজার বছর আগে। রাম-সেতুর বয়স নির্ণয়ে কার্বন ডেটিং পদ্ধতির সাহায্যও নেওয়া হয়েছে। তা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ভারতের রামেশ্বরম ও শ্রীলঙ্কার তালাইমান্নারের মধ্যবর্তী ওই অংশ সমুদ্র থেকে জেগে উঠতে শুরু করেছিল আরও পরে। এর বয়স মোটামুটি ৭ থেকে ১৮ হাজার বছরের মধ্যে। নাসার উপগ্রহ চিত্র আবার জানাচ্ছে, রাম সেতুর বালি চার হাজার বছরের পুরনো হলেও, উপরের পাথর অংশটির বয়স অন্তত সাত হাজার বছর। অর্থাৎ সঠিক বয়স নিয়ে কিঞ্চিৎ মতপার্থক্য থাকলেও, এই সেতু যে বেশ কয়েক হাজার বছরের প্রাচীন, সে নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। সেই অর্থে এর সঙ্গে রামায়ণের সময়কালের যোগ থাকলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
বিশেষজ্ঞেরা অবশ্য সেতুটিকে প্রকৃতির এক আশ্চর্য সৃষ্টি বলেই মনে করেন। তার সঙ্গে সত্যিই রামায়ণের সেই সেতুর সম্পর্ক রয়েছে কিনা তা আজও যুক্তিতর্কের বিষয়। তবে প্রকৃতি যে মাঝেমধ্যেই নিজের খেয়ালে এমন আশ্চর্য সব জিনিসপত্র বানিয়ে ফেলে তা কে না জানে! রাম সেতুই হোক আর আডম’স ব্রিজ, তা-ও আসলে হয়তো তেমনই এক প্রাকৃতিক বিস্ময়। তবে কে না জানে, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর…।