নারীর উন্নয়ন নিয়ে যত কথা, যত আলাপ-আলোচনাই হোক, বাস্তবে কতখানি ফলপ্রসূ হচ্ছে তা? আদতে কতখানি স্বীকৃতি পাচ্ছে নারীর অধিকারের সংজ্ঞা? নাকি সর্ব ক্ষেত্রে তাদের হাত বাঁধাই থাকছে এখনও? সম্প্রতি রাষ্ট্রসংঘের সহযোগিতায় করা সমীক্ষার শেষে কিন্তু নেতিবাচক কথাই জানাচ্ছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
একুশ শতকে পৌঁছে নারীর অধিকার সংক্রান্ত বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনার পরিসর বেড়েছে, এ কথা ঠিক। আলোচনায় উঠে আসছে নারীর উন্নয়নের দিকটিও। মেয়েদের শিক্ষার অধিকার, নিজস্ব উপার্জনের ব্যবস্থা, ঘরে এবং বাইরে প্রাপ্য সম্মান আদায় করা নিয়েও কথা হচ্ছে। এমনকি মেয়েদের সুযোগসুবিধার কথা ভেবে চালু করা হচ্ছে বিভিন্ন প্রকল্প ও নীতিও। কিন্তু বাস্তবে কতখানি কার্যকরী হচ্ছে সেসব কিছু? সম্প্রতি সে কথাই যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের একটি রিপোর্ট। এ দেশে সর্ব ক্ষেত্রে মেয়েদের অবস্থান ঠিক কোথায়, তাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ওই সমীক্ষায়।
আরও শুনুন: মণিপুর থেকে কান… কেন নগ্নতাকেই প্রতিবাদের হাতিয়ার করে তোলেন নারীরা?
১৯৭৯ সালে মেয়েদের প্রতি হয়ে চলা সবরকমের বৈষম্য দূর করার জন্য একটি উদ্যোগ নিয়েছিল রাষ্ট্রসংঘ। গড়ে তোলা হয়েছিল ‘কনভেনশন অন দ্য এলিমিনেশন অফ অল ফর্মস অফ ডিস্ক্রিমিনেশন এগেনস্ট উইমেন’ (Convention on the Elimination of All Forms of Discrimination against Women) নামে একটি সংগঠন। ১৯৯৩ সালে তার সদস্য হয় ভারতও। সেই সূত্রেই এবার এই পর্যবেক্ষণ চালাল জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। এ দেশে নারীকেন্দ্রিক যেসব প্রকল্প, আইন, নীতি নিয়ম ইত্যাদি চালু রয়েছে, বাস্তবে তার প্রয়োগ কীভাবে হচ্ছে এবং কতখানি হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখাই ছিল এই সমীক্ষার উদ্দেশ্য।
আরও শুনুন: প্রাণে বাঁচিয়েছিলেন খোদ মার্কিন রাষ্ট্রপতিকে, প্রথম পেশাদার গোয়েন্দা এই মহিলাই
কমিশনের মতে, সমানাধিকারের ধারণা এবং বাস্তবে তার প্রয়োগের মধ্যে এখনও বিপুল পার্থক্য রয়ে গিয়েছে এ দেশে। একুশ শতকে পৌঁছেও মেয়েদের ক্ষেত্রে শিক্ষা বা কর্মসংস্থানের সুযোগ সবসময় সুলভ নয়। উপরন্তু নারীবান্ধব নয় এমন একাধিক আইন জারি রয়েছে এখনও। এদিকে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে মেয়েদের অংশগ্রহণের ঘাটতিও চোখে পড়ার মতো। দেখা গিয়েছে, আইনপ্রণেতাদের মধ্যে মাত্র ৮.৫ শতাংশ মহিলা রয়েছেন। সত্যি বলতে, যে কোনও উচ্চপদেই মেয়েদের অনুপাত রীতিমতো কম বলেই দেখা গিয়েছে ওই সমীক্ষায়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংরক্ষণের পরেও যে অবস্থাটা বিশেষ পালটায়নি, সে কথাই স্পষ্ট হচ্ছে ওই অনুপাতের নিরিখে। কমিশন জানিয়েছে, ২০১৩ সালের কোম্পানিজ অ্যাক্ট অনুযায়ী স্বাধীন ডিরেক্টরের পদে মহিলাদের জন্য সংরক্ষণ চালু হয়েছিল। কিন্তু তারপরেও সেই সংরক্ষিত পদগুলির অধিকাংশই শূন্য রয়ে গিয়েছে। শুধু তাই নয়, এ দেশের কর্মজগতের সামগ্রিক চিত্রটাও খুব একটা আলাদা নয়। ভারতের মোট জনসংখ্যার মধ্যে যেখানে নারীর সংখ্যা ৪৮.৫ শতাংশ, সেখানে কর্মরতা মেয়েদের পরিসংখ্যান ২৭.৪ শতাংশ মাত্র। এমনকি অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের যাতে প্রাপ্য সুবিধা না দিতে হয়, সেইজন্য বেসরকারি ক্ষেত্রে অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের চাকরি খারিজ করার নজিরও কম নয়। পরিসংখ্যানের হিসেবে লোকসভায় মহিলাদের আসন মোট আসনসংখ্যার ১০.৩৩ শতাংশ আর রাজ্যসভায় তা মাত্র ৮.৮ শতাংশ। এমনকি রাষ্ট্রসংঘের এই বিশেষ সংগঠন, যা মেয়েদের অধিকারের সপক্ষে লড়াই করছে, সেখানেও ৩০ বছরে মাত্র একজন মহিলা সদস্যের দেখা মিলেছে বলে জানাল এই সমীক্ষাটি।
নীতি এবং বাস্তবের মধ্যে এই বড়সড় পার্থক্য পূরণ করার জন্য বেশ কিছু প্রস্তাব দিয়েছে মানবাধিকার কমিশন। কোনও বিজ্ঞানসম্মত যুক্তি না থাকা সত্ত্বেও নারী ও পুরুষের বিয়ের আইনি বয়স কেন আলাদা, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে কমিশন। হিন্দু নাবালকত্ব এবং অভিভাবকত্ব আইনে সাধারণভাবে বাবা-ই অভিভাবকের অধিকার পান। সেখানে মায়েরও সন্তানের উপরে একই অধিকার রয়েছে, এমনটাই দাবি করল কমিশন। এইসব প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে কতটা বদলাবে পরিস্থিতি, সেটাই এখন দেখার।