বিগত কয়েক দশক ধরে তিনি দলের একনিষ্ঠ সদস্য। হনুমান চল্লিশা বিতর্কে যখন মহারাষ্ট্র উত্তাল, শিবসেনা প্রধান উদ্ধব ঠাকরের বাড়ির সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন আশি বছরের এই বৃদ্ধা। যা-ই হয়ে যাক, মাথা নত করতে রাজি নন তিনি। দলের কাছে তাঁর পরিচয় ‘ফায়ার আজ্জি’ বলেই। আর সেই একনিষ্ঠতার স্বীকৃতি দিতে তাঁর ছোট্ট কুটিরে হাজির হয়েছিলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। আজ্জির পায়ে হাত দিয়ে নিলেন আশীর্বাদ। শুনে নিন।
বয়স আশি ছাড়ালে কী হবে! দলের প্রতি তাঁর নিষ্ঠার ঘাটতি হয়নি এতটুকুও। সঙ্গে কমতি নেই সাহসেরও। আর সেই হিম্মতে ভর করেই এবারও বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন বৃদ্ধা। তাঁকে বৃদ্ধা বললে অবশ্য ভুলই বলা হয়। কারণ গোটা দেশ যখন লাউডস্পিকার বিতর্কে উত্তাল, পার্টি প্রধান উদ্ধব ঠাকরের বাড়ির সামনে হনুমান চল্লিশা পাঠ রুখতে গর্জে উঠেছিলেন তিনি। মিডিয়া থেকে শুরু করে সকলের মুখের উপর বলে দিয়েছিলেন ‘ঝুকেগা নেহি’।
হ্যাঁ, বিক্ষোভের মুখে ‘পুষ্পা’ সিনেমার সেই বিখ্যাত সংলাপ বলেই সকলের চোখ টেনে নিয়েছিলেন আশি বছরের এই দলীয় কর্মী। সেই থেকেই দলের বাকি কর্মীদের কাছে তিনি ‘ফায়ার আজ্জি’। সে খবর পৌঁছয় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরের কানেও। আর সেই ফায়ার আজ্জিকে সচক্ষে দেখতেই তাঁর বাসস্থানে হাজির হয়েছিলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। একা নন, সপরিবারে। আজ্জির পায়ে হাত রেখে নিয়েছেন আশীর্বাদও।
আরও শুনুন: বাবরি প্রসঙ্গ টেনে খোঁচা বিজেপিকে, হিন্দুত্বে টক্কর দিতে উদ্ধবের ভরসা সেই মসজিদ-ই
ধর্মস্থানে লাউড স্পিকার বিতর্ককে কেন্দ্র করে ক-দিন ধরেই উত্তাল রাজনীতি। সেই ছায়া পড়েছে মহারাষ্ট্রেও। বিশেষত মসজিদে লাউড স্পিকার ব্যবহার নিয়েই আপত্তি মহারাষ্ট্রের নবনির্মাণ সেনা তথা এমএনএসের। এ নিয়ে আন্দোলনও শুরু করে দিয়েছেন বালাসাহেব ঠাকরের ভাইপো রাজ ঠাকরে। পারিবারিক আত্মীয়তা থাকলেও তাঁদের এই আন্দোলনে পাশে নেই মহারাষ্ট্রে ক্ষমতাসীন শিবেসেনা সরকার। তা প্রথম থেকেই হাবেভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরে ও তাঁর ছেলে আদিত্য।
বিজেপির সঙ্গে দীর্ঘদিন জোটে থাকলেও সেই সম্পর্কে চিড় ধরেছে বহু আগেই। বরং ইদানীং প্রায়শই হিন্দুত্ববাদীদের বাড়াবাড়ি নিয়ে মুখ খুলতে দেখা গিয়েছে উদ্ধবকে। লাউডস্পিকার বিতর্কে রাজ ঠাকরেকে সমর্থন না করায় হিন্দুত্ববাদীদের রোষের মুখে পড়েছেন উদ্ধব। তিনি বালাসাহেবের হিন্দুত্বের আদর্শের থেকে বিচ্যূত হয়েছেন বলে অভিযোগ তুলেছেন কেউ কেউ। সম্প্রতি তাঁর বাড়ি মাতোশ্রীর সামনে হনুমান চল্লিশা পড়ার হুমকি দেন অমরাবতীর নির্দল সাংসদ নভনীত কৌর রানা ও তাঁর স্বামী বাদনেরার বিধায়ক রবি রানা।
এ নিয়ে গোড়া থেকেই মাতোশ্রীর সামনে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছিল। তাঁর বাড়ির সামনে শনিবার সকাল থেকেই জড়ো হয়েছিলেন শিবসেনা সমর্থক ও দলীয় কর্মীরা। মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির সামনে হনুমান চল্লিশা পাঠ করতে এলে তাঁদের বাধার মুখে পড়েন নভনীত ও রানা। সেই দলে ছিলেন এই ফায়ার আজ্জিও।
পেশায় আগে তিনি ছিলেন সবজি বিক্রেতা। স্বামী ও দুই ছেলের মৃত্যুর পরে এক পুলিশ আধিকারিকের বাড়িতে পরিচারিকার কাজ শুরু করে। এ সব ছাড়াও আর একটি পরিচয় রয়েছে চন্দ্রভাগা শিন্ডের। তিনি বহু বছরের পার্টিকর্মী। শিবসেনার জন্য তাঁর আনুগত্য সীমাহীন। সেই কবে শ্বশুরমশাইয়ের হাত ধরে দলে ঢুকে পড়েছিলেন। শিবসেনা তৈরি হওয়া থেকে আজ অবধি সেই আনুগত্যকে টলাতে পারেনি কেউ। এলাকার শিব সেনা শাখার ডেপুটি শাখা প্রমুখের পদও সামলান চন্দ্রভাগা। দলের সুপ্রিমো বাল ঠাকরের সঙ্গেও একবার মুলাকাত হয়েছিল তাঁর। সেই স্মৃতি আজও ভুলতে পারেননা চন্দ্রভাগা।
এর আগেও একাধিক বার শিবসেনার হয়ে প্রতিবাদ, বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন তিনি। কখনও বিজেপির বিরুদ্ধে, তো কখনও এমএনএসের বিরুদ্ধে। এমনকি কঙ্গনা রানাউতের সঙ্গে গন্ডগোলের সময়েও রুখে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। কতবার চোট পেয়েছেন, পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারও হয়েছেন দু-বার। কোনও দিনও এসবের বিনিময়ে পার্টির কাছ থেকে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করেননি বৃদ্ধা। আজও তার কাছে পার্টির উপরে কিছুই নয়।
আরও শুনুন: ‘শুধু মসজিদে আপত্তি! লাউডস্পিকারে মূল্যবৃদ্ধির কথাও বলুন’, রাজ ঠাকরেকে তোপ আদিত্যর
সেই চন্দ্রভাগা যখন শুনলেন, তাঁর বাড়িতে দলীয় প্রধানের পদধুলি পড়তে চলেছে, প্রথমে তো বিশ্বাসই করতে পারেননি। স্থানীয় শিবসেনা কার্যালয় থেকে ফোন এসেছিল তাঁর কাছে। জানতে পারেন, দু-ঘণ্টার মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী সপরিবারে আসছেন তাঁর বাড়িতে। প্যারেলের একটি ঝুপড়িতে নাতি ও ছেলের সঙ্গে থাকেন চন্দ্রভাগা। ততক্ষণে গোটা এলাকা কড়া নিরাপত্তায় মুড়ে ফেলেছে পুলিশ। তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই স্ত্রী রেশমী ঠাকরে ও ছেলে আদিত্যকে নিয়ে আজ্জির বাড়িতে পৌঁছন উদ্ধব। সঙ্গে ছিলেন দলের অন্যান্য কর্তাব্যক্তিরাও।
উদ্ধবের ব্যবহারে মুগ্ধ চন্দ্রভাগা। জানিয়েছেন, তিনি ‘মুখ্যুসুখ্যু’ মানুষ। মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর ছেলে যে ভাবে তাঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছেন, তাতে তিনি আপ্লুত।
৮০ বছরের এই পার্টিকর্মীর সঙ্গে দেখা করে মুগ্ধ মুখ্যমন্ত্রীও। জানিয়েছেন, তাঁর মতো শিব সৈনিকদের জন্যই দল চলছে। তাঁর কথায়, “চন্দ্রভাগার মতো দলীয় কর্মীরা রয়েছেন বলেই আমাদের অস্তিত্ব রয়েছে। যেভাবে প্রবল গরম ও রোদের মধ্যে তিনি এই বয়সেও পার্টির জন্য লড়েছেন তা কুর্নিশযোগ্য।” মুখ্যমন্ত্রী এ-ও জানান, আজ থেকে নয়, তাঁর বাবার সময় থেকেই বিভিন্ন আন্দোলনে চন্দ্রভাগাকে দেখেছেন তিনি। ফায়ার আজ্জিকে একটি গণপতি মূর্তি উপহারও দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। সপরিবারে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে যাওয়ার আমন্ত্রণও জানিয়ে গিয়েছেন তাঁকে। দলের প্রতি যে আনুগত্য ও সাহস এতদিন ধরে দেখিয়ে চলেছেন আজ্জি, তার কাছে এ সমস্তই বোধহয় কম। এমনটাই মনে করেন উদ্ধব।