শান্তিনিকেতন যাওয়ার পথে শক্তিগড়ে নেমে একবার ল্যাংচা চেখে দেখেননি, এমন বাঙালি বিরল। মিষ্টিপ্রিয় বাঙালির কাছে রসগোল্লা সুপারস্টার। তবে ল্যংচাও কিছু কম যায় না! মিষ্টির প্লেটে দুটিরই জায়গা একসঙ্গে, যাকে বলে পাশপাশি। কিন্তু অতিপ্রিয় এই মিষ্টিটির কেন এহেন নামকরণ? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
বাঙালি যে মিষ্টিপ্রিয় সে কথা আর নতুন করে বলার কী আছে! মিষ্টির বাহারি নামগুলোও খেয়াল করার মতো। রসগোল্লা, সন্দেশ তো আছেই। অন্যান্য নামগুলো দেখুন- সীতাভোগ, মোহনভোগ, লবঙ্গলতিকা, চিত্রকূট… প্রিয় মিষ্টির নামকরণেও বাঙালি যে বেশ যত্নশীল, তা তো বোঝাই যাচ্ছে। অথচ সেই বাঙালিই কিনা তার প্রিয় একটা মিষ্টির নাম রেখেছে ল্যাংচা। এইরকম নামের মধ্যে একটু খুঁড়িয়ে হাঁটার আভাস মেলে। অথচ এ মিষ্টি তো খুঁড়িয়ে হাঁটার বস্তুই নয়, রসগোল্লার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দৌড়ায়। তাহলে এমন নাম হল কেন?
আরও শুনুন – সমুদ্রসৈকতের রং নাকি টকটকে লাল! পর্যটকদের বিস্মিত করে এই আশ্চর্য সৈকত
আসলে মিষ্টি স্বাদে যতই দৌড়াক না কেন, যাঁর হাতে তা তৈরি, তাঁরই আভাস এই নামকরণের ভিতর থেকে গিয়েছে। আর তা জানতে আমাদের ফিরে যেতে হবে বাংলার দুই বিখ্যাত রাজ পরিবারের কাছে। শোনা যায়, নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পরিবারের এক মেয়ের বিয়ে হয়েছিল বর্ধমান রাজপরিবারে। সেই মেয়েই মূলত ল্যাংচাকে জগৎসভায় পরিচিত করেন। এ নাম তাঁরই দেওয়া। কিন্তু তিনি যে খুব ভেবেচিন্তে এ নাম দিয়েছিলেন, এমনটা বলা যায় না। বরং বলতে হয়, আর কিছু নাম না পেয়েই তাঁর মুখে এই শব্দটি চলে এসেছিল।
আরও শুনুন – বাঙালির বিরিয়ানিতে আলুর ঠাঁই হল কীভাবে?
প্রচলিত গল্প বলছে, রাজপরিবারের আদরের বধূ যখন সন্তানসম্ভবা তখন স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর শাশুড়িমা নানারকম খাবার খাওয়ানোর চেষ্টা করতেন তাঁকে। এদিকে সুস্বাদু সেই সব খাবারও কিছুতেই মেয়ের মুখে রোচে না। শাশুড়িমা পড়লেন বেজায় ফাঁপরে। একদিন তিনি জানতে চাইলেন, কী খাবার মেয়েটি খেতে চায়! অর্থাৎ কী খেতে তাঁর ইচ্ছে? এই প্রশ্নের উত্তরেই মেয়েটি বলেছিল, ল্যাংচা। এখন এমন খাবারের কথা তো কেউ শোনেনি কোনোদিন। কোথায় মিলবে এই খাবার! শাশুড়িমা পড়লেন চিন্তায়। শুরু হয়ে গেল ল্যাংচার তত্ত্বতালাশ।
আরও শুনুন – কলকাতার রসগোল্লার জন্ম এঁর হাতেই, কীভাবে এল এই সাধের মিষ্টি?
এদিকে বধূ লজ্জায় এ ব্যাপারে বলতেও পারেন না বিশেষ। শেষমেশ তিনি তাঁর স্বামীকে জানিয়েছিলেন যে, বাবার বাড়ি থাকার সময় তিনি এক ধরনের মিষ্টি খেয়েছিলেন। যদিও তার নাম জানেন না। শুধু জানতেন যে, যে ময়রা সেটি বানিয়েছিলেন, তিনি খঞ্জ অর্থাৎ খুঁড়িয়ে হাঁটেন। চলতি কথায় বলে, লেংচে হাঁটা। শাশুড়িমার সামনে খাবারের কথা বলতে গিয়ে আর কিছু শব্দ না পেয়ে তিনি বলে ফেলেছেন ল্যাংচা। রাজবাড়ির বউ খেতে চেয়েছে, আর তা পাওয়া যাবে না, এমন আবার হয় নাকি! মেয়ের মুখে মিষ্টির কথা শোনার পর বর্ধমান রাজপরিবার থেকে তড়িঘড়ি লোক গেল নদিয়ায়। খুঁজে বের করা হল সেই ময়রাকে। তারপর রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের অনুমতি নিয়েই ময়রাকে আনা হল বর্ধমানে। তাঁকে জায়গা-জমি দেওয়া হয়, যাতে তিনি বসবাস করতে পারেন আর তার সঙ্গে তাঁর হাতের বিশেষ মিষ্টি খাওয়াতে পারেন সকলকে।
সেই শুরু। তারপর থেকে ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠল ল্যাংচা। তবে মিষ্টি যতই স্বাদের হোক না কেন, নাম আর বদলাল না। অবশ্য নাম যাই-ই হোক না কেন, বাঙালি আজও আদর করে হাতে তুলে নেয় সেই মিষ্টিকে।