যুদ্ধের সাইরেন বাজছে অনর্গল। তার সঙ্গে কানে আসছে বিস্ফোরণের শব্দ। স্ত্রীর পাঠানো যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনের ছবি তাঁকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল ভিতর থেকে। আর সময় নষ্ট করেননি। স্ত্রীকে বাঁচাতে গাড়ি নিয়ে ছুটে এসেছেন একাই। টানা ২৪ ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে পেরিয়ে এসেছেন পাঁচটি দেশ। অতিক্রম করেছেন প্রায় ২ হাজার কিলোমিটার। শেষ পর্যন্ত কি পৌঁছনো হল তাঁর স্ত্রীর কাছে? দেখা হল কি দুজনের? কীভাবে এই অসাধ্য সাধন করলেন তিনি। আসুন শুনে নিন।
আকাশ জুড়ে যুদ্ধের কালো ধোঁয়া। শহর জ্বলছে। রুশ বোমা থেকে বাঁচতে পড়িমরি করে দৌড়োচ্ছেন বাসিন্দারা। কোনওমতে বাঙ্কারে ঢুকে মাথা বাঁচাচ্ছেন অসংখ্য মানুষ। মোবাইলে এই দৃশ্য দেখে স্থির থাকতে পারেননি তিনি। কী করেই বা পারতেন! ওই প্রাণভয়ে দৌড়নো মানুষের মিছিলে যে রয়েছেন তাঁর স্ত্রীও। আর বেশি সময় নেননি। বিপদগ্রস্ত স্ত্রীকে বাঁচাতে সঙ্গে সঙ্গে রওনা দিয়েছেন স্বামী। একা গাড়ি চালিয়ে এসেছেন প্রায় ২ হাজার কিলোমিটার। পেরিয়ে এসেছেন পাঁচ-পাঁচটি দেশ।
আরও শুনুন: যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ! প্রাণভয়ে সন্তানকে নিয়ে ঘরছাড়া প্রাক্তন ইউক্রেন-সুন্দরী
বছর পঁয়ষট্টির স্টিভ লুকাস থাকেন ব্রিটেনের ওয়েলসে। কর্মসূত্রে ইউক্রেনে এসে আলাপ হয় অ্যানাসটেসিয়ার সঙ্গে। সেখান থেকে প্রেম। পাঁচ বছর আগে বিয়ে সারেন তাঁরা। ব্রিটিনের অভিবাসী আইনের গেঁরোয় কিয়েভেই থেকে যেতে হয়েছিল অ্যানাসটেসিয়াকে। তার মধ্যেই ইউক্রেনে লেগে গেল রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ।
যুদ্ধে শুরুর পর থেকে সব সময়ই দুশ্চিন্তা তাড়া করে ফিরত স্টিভকে। কেমন আছেন অ্যানাসটেসিয়া? ঠিক আছেন তো! ভিডিয়ো কল, মোবাইলের মাধ্যমে স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলতেন সব সময়।
এরই মধ্যে একদিন অ্যানাসটেসিয়া ছবি পাঠান যুদ্ধবিধ্বস্ত শহরের। অ্যাপার্টমেন্টের চারপাশে কালো ধোঁয়া দেখে ভয় পেয়ে যান স্টিভ। স্ত্রী জানান, রাত্রিদিন আতঙ্কে দুচোখের পাতা এক করতে পারছেন না। একটু মাথা বাঁচানোর আশ্রয় খুঁজতে দৌড়ে বেড়াচ্ছেন এ বাঙ্কার থেকে সে বাঙ্কারে। প্রতিদিন মৃতদেহের উপর দিয়ে এভাবে মাথা বাঁচানোর জায়গা খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলেন অ্যানাসটোসিয়া।
আতঙ্ক বাড়ছিল কয়েক হাজার মাইল দূরে বসে থাকা স্টিভেরও। তবে সেদিনের দৃশ্য দেখার পরে আর স্থির থাকতে পারেননি তিনি। নিজের গাড়ি নিয়ে রওনা হন ইউক্রেনের উদ্দেশে। কিন্তু এ তো আর পাশের পাড়া নয়। মাঝখানে প্রায় কয়েকটা দেশের দূরত্ব। না, অতশত ভাবার সময় ছিল না স্টিভের হাতে। বেড়িয়ে পড়েন তিনি। নিজে গাড়ি চালিয়ে পার হয়ে যান একের পর এক শহর। টানা ২৪ ঘণ্টা লাগাতার গাড়ি চালিয়ে গিয়েছেন স্টিভ। ফ্রান্স, বেলজিয়াম, জার্মানি পেরিয়ে পোল্যান্ড হয়ে যখন ইউক্রেনের সীমান্তে পৌঁছলেন তখন অনেক রাত। সে সময়টুকু কোনও মতে গাড়িতে কাটিয়ে আলো ফুটলেই ইউক্রেনের লিভিউ শহরে পৌঁছে যান স্টিভ। যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকা ছেড়ে কোনও মতে পালিয়ে এসেছিলেন অ্যানাসটেসিয়া। এক ট্যাক্সিওয়ালার সাহায্যে অবশেষে স্টেশনে পৌঁছন অ্যানাসটেসিয়া। শেষমেশ দেখা হয় দুজনের ।
আরও শুনুন: রুশ কবল থেকে বাঁচাতে হবে শহর! ব্যস্ত হাতে ব্যারিকেড গড়ছে একদল খুদে
আগেই স্ত্রীকে পোল্যান্ডে চলে আসতে বলেছিলেন স্টিভ। তখন রাজি হননি অ্যানাসটোসিয়া। পরিস্থিতি যে এত দ্রুত খারাপ হয়ে যাবে ভাবতে পারেননি কেউই। স্ত্রীকে নিজের কাছে পেয়ে সামান্য হলেও স্বস্তি ফিরেছে স্টিভের। এর পরে আর অ্যানাসটোসিয়াকে নজরবন্দি করতে নারাজ তিনি। এবার যে কোনও ভাবে ব্রিটেনের ভিসা তিনি জোগার করবেনই স্ত্রীয়ের জন্য। আপাতত গাড়িতে করেই স্ত্রীকে নিয়ে ইউক্রেন ছাড়তে চান স্টিভ। সেই রাস্তাটুকু যাতে নিরাপদে পেরিয়ে যেতে পারেন, আপাতত ঈশ্বরের কাছে সেটুকু ছাড়া আর কিছু চাওয়ার নেই তাঁদের।