শ্মশানে গিয়ে রাত্রিতে ধ্যান করতেন। এমন অবস্থা হল যে, গ্রামের সকলে ভাবতে লাগলেন যে ঠাকুরের উপর বুঝি অপদেবতার ভর হয়েছে। সেইমতো একজন ওঝাকেও ডেকে আনা হল। এই করে মাস কয় কাটল। ঠাকুর ক্রমে যেন একটু প্রকৃতিস্থ হলেন। তবে তাঁর ধ্যান এবং সাধনা চলতেই থাকল। বাড়ির লোক ভাবেন, তিনি উন্মাদ হয়ে গিয়েছেন।
সাধনায় ডুবে আছেন ঠাকুর। ঈশ্বর আর তাঁর ভিতর যা বাধার মতো এসে দাঁড়াচ্ছে, তাই-ই সরিয়ে দিচ্ছেন কঠোর হাতে। শরীরবোধ প্রায় লুপ্ত। কিন্তু এরকম করলে শরীরই বা থাকবে কী করে! এত অসুস্থ হয়ে পড়েন এই তরুণ পূজারী যে আশেপাশে যাঁরা থাকেন, তাঁরা যেন সেই কষ্ট সহ্য করতে পারেন না। ঠাকুরের ভাগ্নে হৃদয় পরম যত্নে তাকে খানিকটা সুস্থ করে তোলেন। কিন্তু ঠাকুরের সাধনায় কোনও ছেদ পড়ে না।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ২২): মা কালীর পাশাপাশি মা সীতারও দর্শন পেয়েছিলেন ঠাকুর
ঠাকুরের এই অবস্থা দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন রানিমা এবং মথুরবাবু। সেই আমলের খ্যাতনামা এক চিকিৎসককে ডেকে আনা হল তাঁর চিকিৎসার জন্য। কাজের কাজ কিছুই হল না। ঠাকুরকে এই কৃচ্ছ্রসাধন থেকে সরিয়ে আনার আর একরকমের চেষ্টাও করা হয়েছিল। ভাবা হয়েছিল, যদি রমণীদর্শন করে ঠাকুর তাঁর সাধনা থেকে সাময়িক সরে আসেন, তবে অন্তত দেহটুকু রক্ষা করা হয়। তাঁর অসুস্থতা নিয়ে ভীষণ উদ্বেগ থেকেই এরকম ভাবনা ভাবা হয়েছিল। কিন্তু তাও বিফলে গেল। দু-একজন রমণীকে সামনে আনা হলেও, ঠাকুর তাঁর সাধনা থেকে বিন্দুমাত্র সরলেন না। শেষমেশ এই চেষ্টার জন্যই অনুতপ্ত হয়েছিলেন সকলে।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ২১): ঠাকুরের আশ্চর্য ক্ষমতার পরিচয় পেয়েছিলেন রানি রাসমণি
কিন্তু উপায়টা কী! এভাবে চললে যে তরুণ পূজারী বেশিদিন থাকবেন না, তা যেন বোঝাই যাচ্ছিল। শেষমেশ ঠিক করা হল, কিছুদিনের জন্য তাঁকে কামারপুকুরে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। দক্ষিণেশ্বর থেকে নিজের জন্মভিটেয় ফিরে গেলেন ঠাকুর। কিন্তু তাতে বিশেষ হেরফের কিছু হল না। শ্মশানে গিয়ে রাত্রিতে ধ্যান করতেন। এমন অবস্থা হল যে, গ্রামের সকলে ভাবতে লাগলেন যে ঠাকুরের উপর বুঝি অপদেবতার ভর হয়েছে। সেইমতো একজন ওঝাকেও ডেকে আনা হল। এই করে মাস কয় কাটল। ঠাকুর ক্রমে যেন একটু প্রকৃতিস্থ হলেন। তবে তাঁর ধ্যান এবং সাধনা চলতেই থাকল। বাড়ির লোক ভাবেন, তিনি উন্মাদ হয়ে গিয়েছেন। যুবক ছেলে, সংসার বিষয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন। এভাবে চলবে কেমন করে! অনেক ভেবে তাঁরা ঠিক করলেন, বিবাহই দেওয়াই একমাত্র উপায়। গোড়ায় ভাবা হয়েছিল, এ প্রস্তাবে ঠাকুর বুঝি বেজায় আপত্তি করবেন। কিন্তু যখন তাকে বলা হল, তিনি তখনই সম্মতি জানালেন। এবার শুরু হল পাত্রীর খোঁজ। কিন্তু কাছেপিঠে মনের মতো পাত্রী আর পাওয়া যায় না। একদিন গদাধর নিজেই বললেন, জরামবাটীর রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কন্যার কথা। বললেন, সেখানেই তাঁর কুটো বাঁধা হয়ে গিয়েছে। প্রথমে তাঁর কথাকে কেউ গুরুত্ব দেননি। তবু একবার খোঁজ নিয়ে দেখতে তো ক্ষতি নেই। আর খোঁজ করে দেখা গেল, সত্যিই পাত্রী আছে। তিনি সারদামণি। বিয়েতে কোনও পক্ষের অমতও থাকল না। ঠাকুর তখন তেইশ বছরের যুবক। সারদামণির বয়স পাঁচ। সেকালে এমন বিবাহ প্রচলিত ছিল। কিছু নিয়মকানুনও এক্ষেত্রে মেনে চলতে হত। বিয়ে মানেই বিবাহের সব অনুষ্ঠান হত না। কন্যা বড় হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হত।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ২০): ঠাকুরের পুজোর ধরনে রেগে আগুন কর্মচারীরা, পাশে ছিলেন রানিমা
কিন্তু ঠাকুরের ক্ষেত্রে এই বিবাহ যেন এল তাঁর সাধনপদ্ধতির আর একটা ধারা হয়ে। আমরা আগেই জেনেছি যে, ঠাকুর নিজের মতো করে সাধনার পথ খুঁজে নিয়েছিলেন। সারদামণির সঙ্গে আজীবন তিনি যে দিব্য প্রেমের ভাব বজায় রাখবেন, তা কোনও সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। এখানেই ঠাকুরের সাধনার জোর। আরও একবার যেন তিনি নিজেকে পরীক্ষা করে নিতে চাইছেন। উত্তরকালে আরও বিভিন্ন পদ্ধততে তিনি নিজেকে পরীক্ষা করবেন। এমরা একে একে তা শুনে নেব।