শুরু থেকেই তিনি ব্যতিক্রমী। নিজের সৃষ্টির উপর কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের চোখরাঙানি তিনি পছন্দ করেননি কোনও কালেই। আর তাই নিজের সৃষ্টিকে শুধু বিনোদন বলেও ভাবতেও চাননি । শিল্প হিসেবে তার চেয়েও গভীরতম দাবি রয়েছে সেই সৃষ্টির, এমনটাই বিশ্বাস করতে চেয়েছেন বরাবর। তিনি সর্বকালের সেরা সঙ্গীতকার। তাঁর হাতের জাদুতে অন্ধ মেয়ে খুঁজে পায় জ্যোৎস্নারাত্তিরের মুগ্ধতা। তিনি বেঠোভেন। জীবনের শেষ দিকে কমে আসছিল শ্রবণশক্তি। তবে সেই অক্ষমতাও টলাতে পারেনি শিল্পীর তাগিদকে। মঞ্চে শব্দতরঙ্গকে অনুভব করতে বের করে ফেলেছিলেন অদ্ভুত একটা প্রযুক্তি। কী করেছিলেন বেঠোভেন? আজ শুনব সেই গল্পই।
তিনি বেঠোভেন- বিশুদ্ধ সঙ্গীতের সাধক। সমস্ত বিনোদনের ঊর্ধ্বে গিয়ে যে সঙ্গীত আসলে অনেক বেশি করে শিল্প, সেখানেই তাঁর আস্থা ছিল বরাবর। একজন সঙ্গীতকারের জন্য প্রথম শ্রোতা তো স্বয়ং তিনিই। কিন্তু বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সেই শ্রোতাটিকেই ক্রমশ হারিয়ে ফেলছিলেন বেঠোভেন। বিশ্বাসঘাতকতা করছিল নিজের দুটি কানই। প্রথম দিকে কিছু কিছু ফ্রিকোয়েন্সির শব্দই কেবল শুনতে পেতেন না বেঠোভেন। পরে সেই সমস্যা আরও বাড়ল। ক্রমশ বধির হয়ে যেতে লাগলেন তিনি।
কিন্তু তাঁর জীবন আর সঙ্গীত তো আলাদা কিছু নয়। তাই এত বড় প্রতিবন্ধকতাও তার পথ আটকাতে পারল না। তাঁর সঙ্গীত সাধনায় ফাঁক পড়ল না এতটুকু।
লুডভিগ ফান বেঠোভেন। তিনিই সম্ভবত সে সময়কার প্রথম সঙ্গীকার, যিনি কারও নির্দেশে সঙ্গীত সৃষ্টি করেননি কোনওদিন। জার্মানিতে জন্ম হলেও জীবনের বেশির ভাগ সময়টাই কাটিয়েছেন ভিয়েনায়। সঙ্গীতকার হিসেবে একের পর এক বৈপ্লবিক বদল এনেছেন মানুষটি। শব্দ ও মাত্রা নিয়ে নিজের সৃষ্টিতে এমন ভাবে খেলেছেন বেঠোভেন, যা বিশ্বসঙ্গীতের ইতিহাসে সম্ভবত প্রথম।
আরও শুনুন: দুর্ধষ গুপ্তচর আবার তিনি গান্ধী অনুগামীও… সিনেমাকেও হার মানায় এই সাহসিনীর জীবন
ক্রমে খ্যাতির চূড়োয় পৌঁছচ্ছিলেন বেঠোভেন। শরীরও খারাপ হচ্ছিল ক্রমশ। একটা সময় পুরোপুরি শ্রবণশক্তি হারিয়ে গেল। সেটা বোধহয় ১৮২৪ সাল। ভিয়েনায় প্রথম বার মঞ্চে বেঠোভেনের নাইনথ সিম্ফোনি পরিবেশিত হবে। দশর্কাসন কানায় কানায় ভর্তি। ১২ বছর পরে মঞ্চে অনুষ্ঠান করবেন বেঠোভেন। এত বড় কনসার্ট, সুবিশাল অর্কেস্ট্রা এর আগে দেখেনি বিশ্ব। যন্ত্রের পাশাপাশি মানুষের কন্ঠও থাকবে এবারের অর্কেস্ট্রায়। আর তা-ও বোধহয় ইতিহাসে প্রথম।
মঞ্চের পর্দা খুলে গেল। দর্শকদের দিকে পিঠ করে দাঁড়ালেন বেঠোভেন। শরীর ঝাঁকিয়ে হাত নেড়ে নেড়ে সঙ্গীত পরিচালনা করছিলেন শিল্পী। সুরমূর্চ্ছনায় ভাসছে অডিটোরিয়াম। এক সময় সুর থামল। কিন্তু থামলেন না বেঠোভেন। মোহিত হয়ে তখনও তিনি পরিচালনা করে যাচ্ছেন। দর্শকদের অভিনন্দন, তুমুল হাততালি একবিন্দুও ঢুকল না তাঁর কানে। কী করে ঢুকবে! ততদিনে যে তাঁর শ্রবণশক্তি হারিয়ে গিয়েছে পুরোপুরি।
আরও শুনুন: বাঙালি খানসামার সঙ্গে মহারানির ‘বিশেষ’ সম্পর্ক, তোলপাড় পড়েছিল বিশ্বে
তিনি শিল্পী। শরীরি প্রতিবন্ধকতার সামনে হার মেনে নেবেন এত সহজে! কিছুতেই নয়। হাল ছাড়েননি বেঠোভেন। বধির অবস্থাতেও একের পর এক সঙ্গীত তৈরির চেষ্টা করে গিয়েছেন। পিয়ানোকে আঁকড়ে ধরেছেন আরও বেশি করে। কীভাবে পিয়ানোর শব্দকে আরও কয়েক গুণ বাড়িয়ে তোলা যায়, সে নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করে যাচ্ছিলেন লাগাতার।
তবে এরই মধ্যেই অন্য একটা বুদ্ধি বের করে ফেললেন তিনি। তখনও হিয়ারিং এইড আবিষ্কার হয়নি। একটা ধাতব রডকে পিয়ানোয় লাগিয়ে নিলেন কোনও ভাবে। পিয়োনা বাজানোর সময় সেটিকে দাঁত দিয়ে ধরে রাখতেন। যাতে কম্পনের মাধ্যমে শব্দতরঙ্গকে অনুভব করতে পারেন। এই পদ্ধতিকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলে বোন কনডাকশন। অর্থাৎ শরীরের হাড়ের মধ্য দিয়ে কম্পনকে পরিবাহিত করা। পরে হিয়ারিং এইড বানাতে গিয়ে এই প্রযুক্তিকে ব্যবহার করেছেন বিজ্ঞানীরা। শ্রবণশক্তি হারানোর চিকিৎসাতেও অনেক সময়ই ব্যবহার করা হয় এই প্রযুক্তির।
৪৫ বছর বয়সে সম্পূর্ণ বধিরতা গ্রাস করার পরে অনেকেই বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছিলেন বেঠোভেনকে। আর সেখান থেকেই ঘুরে দাঁড়ান তিনি। বোন কনডাকশন প্রযুক্তি ব্যবহার করে এর পরেও দুর্দান্ত সব সঙ্গীত তৈরি করে গিয়েছেন লাগাতার। কারণ তিনি বেঠোভেন। পিয়ানোয় নয়, তিনি সঙ্গীত সৃষ্টি করতেন তাঁর মাথায়। আর সেখানে তিনি অপ্রতিরোধ্য।