আজকাল প্রায় সব ঋতুতেই তো বৃষ্টিবাদল লেগেই থাকে। যতই বর্ষাতি থাক। বৃষ্টিতে কিংবা রোদে ছাতার কিন্তু জবাব নেই। তবে এককালে নাকি এই ছাতাকে নেলপালিশ, লিপস্টিকের মতো শুধুমাত্র মেয়েদের ব্যবহারের জিনিস বলেই ধরা হত। পুরুষেরা ছুঁয়েও দেখতেন না সেসব। তবে সেই ধারা বদলে দিয়েছিলেন এক ব্যক্তি। কীভাবে এল সেই বদল, সেই গল্পই আজ আপনাদের শোনাব।
গ্রীষ্ম কিংবা বর্ষা, ভরসা কিন্তু ছাতা। এই দারুণ কাজের জিনিসটির উপরে এককালে নাকি কেবল মেয়েদেরই একচ্ছত্র অধিকার ছিল। ১৮ শতকের দিকে ইংল্যান্ডে শুরু হয় ছাতা ব্যবহারের চল। তবে তা ছিল রোদের হাত থেকে বাঁচতে। অবশ্য সেগুলোকে ছাতা না বলে প্যারাসোল বলাই ভাল। বৃষ্টির থেকে রোদ্দুর বাঁচাতেই বেশি ব্যবহার হত সেসব। ছাতার উৎপত্তি কিন্তু সেখান থেকেই। ‘আমব্রেলা’ শব্দটি এসেছে লাতিন শব্দ ‘আমব্রা’ থেকে, যার অর্থ ছায়া। প্রাচীন সভ্যতার মানুষেরা নাকি বৃষ্টির থেকেও বেশি ভয় পেতেন রোদকে। তাই তার থেকে বাঁচতেই আবিষ্কার হয় ছাতার।
ঠিকই শুনেছেন, প্রাচীন মানুষের হাতেই প্রায় কয়েক হাজার বছর আগে তৈরি হয়েছিল প্রথম ছাতা। তখন অবশ্য তা দেখতে অন্যরকম ছিল। বাঁশ, তালপাতা কিংবা ময়ুরের পালক, এসব দিয়েই তৈরি হত সে সময়ের ছাতা। মেসোপটেমিয়া সভ্যতাতে ছাতা ব্যবহারের নজির ছিল। তবে যীশুখ্রিস্টের জন্মের ১২০০ বছর আগে মিশরে ‘নাট’ নামে এক দেবীকে খুব মান্যগণ্য করত সেখানকার মানুষজন। ‘নাট’ ছিলেন আকাশের দেবী। পায়ের পাতা ও হাতের আঙুল দিয়ে বক্রাকারে মাটি স্পর্শ করতেন সেই দেবী। তাঁর প্রতিকৃতি ছিল তেমনই, অনেকটা ছাতার মতোই। তাই ছাতাই হয়ে উঠেছিল মিশরীয়দের কাছে সেই দেবীর প্রতীক। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই সমাজের সব ধরনের মানুষ এই ছাতা সঙ্গে রাখতে পারতেন না। সমাজের মান্যগণ্য ব্যক্তিদের কাছেই থাকত কেবল ছাতা। আর তাঁদের সঙ্গে এক ছাতার তলায় দাঁড়ানো সাধারণ মানুষের কাছে ছিল রীতিমতো সৌভাগ্যের ব্যাপার।
আরও শুনুন: মিকি মাউসকে আঁকেননি ওয়াল্ট ডিজনি! তবে কে তার স্রষ্টা?
মিশরীয় সভ্যতার থেকে অনেক কিছুই গ্রহণ করেছিল রোমান ও গ্রিকরা। সেভাবে একদিন পৌঁছে গিয়েছিল ছাতাও। তবে ইংল্যান্ডে শুধুমাত্র মেয়েদের ব্যবহারের জিনিস বলেই তা সুখ্যাতি পেল। রোদের হাত থেকে বাঁচতে তো বটেই, ক্রমশ তা হয়ে উঠল বৃষ্টি থেকে মাথা বাঁচানোর অস্ত্রও। তার জন্য ছাতার কাপড়ে লাগিয়ে নেওয়া হল মোম কিংবা তেলের আস্তরণ। আর ব্যাস, অমনি তা হয়ে গেল ওয়াটারপ্রুফ।
তবে একটা ব্যপারে খুবই আপত্তি ছিল জোনাস হ্যানওয়ে নামে ব্রিটিশ এক ব্যক্তির। ছাতার মতো দারুণ কাজের একটা জিনিস, অথচ তার উপর মহিলাদেরই কেবল একচেটিয়া অধিকার! সেই ধারা বদলাতে উঠে পড়ে লাগলেন হ্যানওয়ে। রীতিমতো ধনী ছিলেন এই ব্যাক্তি। তিনি ঠিক করলেন, দেশে আর কেউ ব্যবহার করুক ছাই না করুক, তিনি ছাতা ব্যবহার করবেনই। আর তাই সবসময় ছাতা নিয়ে এদিক সেদিক টহল দিয়ে বেড়াতেন। সবাইকে বোঝাতে চাইতেন, ছেলেরা ছাতা ব্যবহার করলে তেমন কোনও মহাভারত অশুদ্ধ হবে না।
তবে তার জন্য প্রচুর কথা শুনতে হত হ্যানওয়েকে। একদল লোকের সামনে হাসিঠাট্টাও করা হত তাঁকে নিয়ে। তবে পাত্তা দিতেন না তিনি। বৃষ্টিবাদলার দিনে লন্ডনে সবাই যখন গাড়ি খুঁজে খুঁজে হন্যে হত, তখন ছাতা মাথায় দিয়ে দিব্যি হেঁটে বেড়াতেন হ্যানওয়ে। গায়ে একফোঁটাও জল লাগত না। সবাই কিন্তু বেশ হিংসার নজরেই দেখতেন তাঁকে।
আরও শুনুন: মানুষ নয়, পৃথিবীর প্রথম গোয়েন্দা একটি কুকুর… খোঁজ মেলে তার ঋগ্বেদে
তবে এত কষ্টের ফল মিলল ৩০ বছর পরে। ততদিনে ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে সকলের হাতেই উঠে এসেছে ছাতা। শেষ বয়সে এসে সম্মান পেলেন জোনাস হ্যানওয়ে। ‘হ্যানওয়েজ’ হয়ে উঠল ছাতারই নামান্তর। হাজার হাজার বছর আগে আবিষ্কার হলেও ছাতাকে জনপ্রিয় করার পিছনে হাত ছিল এই ব্রিটিশ ভদ্রলোকেরই। তার জন্য কম হাসিঠাট্টা, কম সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে। ভাগ্যিস সেদিন তিনি লোকের সমালোচনাকে ভয় পেয়ে পিছিয়ে আসেননি! নয়তো বর্ষার দিনগুলো আমাদের সকলের জন্য বোধহয় এতটা স্বস্তিদায়ক হত না।