চিংড়ি মাছের মালাইকারি। এই তিনটি শব্দে জিভে জল আসে না, এমন বাঙালি ভূ-ভারতে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কিন্তু খেয়াল করে দেখেছেন কি, মালাইকারিতে ‘মালাই’ জিনিসটাই থাকে না। তাহলে! এমন বাহারি নামখানা এল কোথা থেকে! আসুন,একটু চেটে… এই থুড়ি… হেঁটে দেখা যাক, মালাইকারির দেশের সন্ধান মেলে কি-না!
সেই যেমন বলা হয়ে থাকে যে, ‘বাগবাজারে বাগ নেই’, ‘হাতিবাগানে হাতি নেই’, তেমনই যেন বলা যায়, ‘মালাইকারিতে মালাই নেই’। কিন্তু এতদিন চেটেপুটে যখন এই সুস্বাদু পদটি সাফ করা হয়েছে, তখন কে আর মনে রেখেছে তাতে মালাই আছে না নেই! তা খাবার সময় মনে না থাকলেও, খাবার পরে এ নিয়ে মাথা ঘামানোর যথেষ্ট কারণ আছে বইকি! কেননা যে পদে জিভে জল আসে, তার নামে এমন গরমিলই বা থাকবে কেন! ব্যাপারটা কী!
আরও শুনুন – মানুষের মতো দেখতে যেন না লাগে! ১২ লক্ষ টাকা খরচ করে নিজের চেহারা বিকৃত করছেন যুবক
বিষয়টি নিয়ে বহু আগেই ভেবেছিলেন রাধাপ্রসাদ গুপ্ত মশাই। তাঁর আগেও এ নিয়ে অনেকেই চর্চা করেছেন। যেমন, রাধাপ্রসাদ জানাচ্ছেন, মালাইকারি নিয়ে বিজনবিহারী ভট্টাচার্যের মত ছিল এরকম যে- ‘মালাই’ শব্দটি এসেছে ফরাসি ‘বালাহ’ শব্দ থেকে। যার অর্থ ঘন দুধ বা ক্ষীর। কিন্তু কথা হল, মালাইকারিতে দুধ থাকে না। থাকে নারকোলের দুধ! তাকেই কি তবে মালাই বলা হচ্ছে? খটকা কিছু থেকেই যায়। রাধাপ্রসাদ বুঝলেন, এত সহজে হাল ছাড়া যায় না; ব্যাপারটাকে কালটিভেট করতেই হচ্ছে। অতএব তিনি নেমে পড়লেন অনুসন্ধানে। আর কে না জানে, স্বয়ং রাধাপ্রসাদ গুপ্ত যখন সন্ধানে নেমেছেন,তখন বাঙালির প্রাপ্তি আখেরে হবেই হবে। হলও তাই।
আরও শুনুন – প্রিয় রংয়ের সঙ্গেই সাতপাকে বাঁধা পড়লেন কনে, দেখে অবাক অতিথিরা
হিন্দিতে আবার ‘মালাই’ শব্দের অর্থ হালকা বাদামি। সেই রং ধরেই কি পদের এমন নামকরণ? সন্ধান জারি রইল রাধাপ্রসাদের। বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায় থেকে লীলা মজুমদার – সর্বত্রই গোয়েন্দাগিরি চালান তিনি। রেসিপি সবারই এক। লীলা মজুমদার বলেছেন, প্রয়োজনে কারি পাতা দিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু পদটির উৎস কোথায়, তা তিনি বলেননি। তবে এখানেই একটা ক্লু থেকে গিয়েছিল। শেষমেশ রোজ মেরি ব্রিসেনডেনের বইতে রাধাপ্রসাদ পেলেন একটি পদ, যার নাম, ‘ফ্রায়েড প্রন কারি’। দেখলেন, এই পদ আসলে ‘মালাইকারি’-ই। ইংরেজিতে ‘কারি’ কথাটা এসেছে কারি পাতা থেকেই। এই কারি পাতার ব্যবহার, যার পরামর্শ লীলা মজুমদারও দিয়েছিলেন, তা জানান দিচ্ছে, মালাইকারি মূলত তামিল রান্না। তামিলরা বহুকাল পূর্বে যখন মালয়ে গিয়েছিলেন, তখন সম্ভবত এ রান্নার আবির্ভাব। সেই হিসাবে, রান্নাটির আদিনাম ছিল মালয়-কারি। পরে মুখে মুখে ফিরতে ফিরতে তা হয়ে দাঁড়িয়েছে মাইলাইকারি। এই সিদ্ধান্তেই থিতু হয়েছেন রাধাপ্রসাদ। আমরাও সেখানেই দাঁড়াই। মালয় থেকে মালাই হয়েছে, এইটেই মালাইকারির সবথেকে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা। নইলে মালাইকারিতে কেন মালাই নেই এই নিয়ে লাঠালাঠি বাঁধার জোগাড়।
যাই হোক, সাকিন-ঠিকানার খোঁজ তো মিলল। মালাই নিয়ে আর নিশ্চই কোনও সন্দেহ থাকার কথা নয়। আর যদি থেকেও থাকে, মালাইকারির অপূর্ব স্বাদে সেইসব তর্ক, তত্ত্ব যে গলে জল হয়ে যাবে, তা একরকম হলফ করেই বলা যায়।