ভারতবর্ষকে ভালবেসে এ দেশে এসেছিলেন আয়ারল্যান্ডের মেয়ে মার্গারেট নোবেল। আপন করে নিয়েছিলেন এই দেশকেই। তাঁকে আমরা চিনি ভগিনী নিবেদিতা নামে। তবে তাঁর আগেও এ দেশকে একইভাবে নিজের বলে স্বীকার করেছিলেন তাঁর স্বদেশীয় একজন সাহেব। কৃষ্ণপ্রেমে ডুবে থাকতেন তিনি। কে এই সাহেব?
সাউথ পার্ক স্ট্রিট সিমেট্রিতে অজস্র সমাধির মধ্যে থেকে চোখ টানে একটি বিশেষ সমাধি। না, মৃত মানুষটির নামের কারণে নয়। উইলিয়াম জোন্স থেকে হেনরি ডিরোজিও, অনেক নামকরা মানুষই শুয়ে আছেন এই সমাধিস্থলে। সেখানে চার্লস স্টুয়ার্টের নাম কজন আদৌ শুনেছেন, সন্দেহ আছে। তবুও তাঁর সমাধি দেখে অবাক হয়ে যান দর্শকেরা। স্বাভাবিক। খ্রিস্টান কবরখানায় যদি এমন কোনও সমাধি চোখে পড়ে, যার আদল অনেকটা মন্দিরের মতো, আর সেই সমাধির উপরে ক্রস থাকার বদলে যদি দেখা যায় পদ্মফুলের মোটিফ, তাতে অবাক হয়ে যাওয়ারই তো কথা। আর তখনই প্রশ্ন জাগে, কে এই চার্লস স্টুয়ার্ট? কেনই বা এমন আলাদাভাবে তৈরি হয়েছিল তাঁর সমাধিসৌধ?
আরও শুনুন: ফাঁসি দিত ইংরেজরা, রাস্তার ধারে ঝুলত মৃতদেহ, কলকাতার সেই রাস্তার নাম কী জানেন?
বাণিজ্যের সূত্রে, পর্যটনের নেশায়, মধ্যযুগ থেকেই ভারতে পা রেখেছেন কত বিদেশি। আর পলাশির যুদ্ধের পর তো সেই সংখ্যাটা বেড়ে গিয়েছিল হুহু করে। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ নিজেদের বেঁধে রেখেছিলেন নিজেদের চেনা যাপনেই, আবার কেউ কেউ নতুন দেশের রীতিনীতিকে আপন করে নিয়েছিলেন, বদলে গিয়েছিলেন বেশ খানিকটা। তবে চার্লস স্টুয়ার্টের মতো নিজেকে এমন আদ্যোপান্ত বদলে নেওয়া সাহেব বোধহয় আর দুটি খুঁজে পাওয়া যাবে না। পলাশির যুদ্ধ জয় করে যখন বাংলার শাসনভার দখল করছে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, স্টুয়ার্ট তখনও মাতৃগর্ভে। এর ঠিক পরের বছর, ১৭৫৮ সালে জন্ম হয় তাঁর। ভগিনী নিবেদিতার দেশ আয়ারল্যান্ডে। আর ১৯ বছর বয়সে ভাগ্য তাঁকে এনে ফেলল সুদূর প্রাচ্যের সেই উপনিবেশটিতেই, যার নাম ভারতবর্ষ। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাবাহিনীতে কাজ করার সূত্রে ভারতে তথা কলকাতায় এসেছিলেন সাহেব। সাধারণ সৈনিক থেকে ক্রমে পদোন্নতির ফলে মেজর জেনারেল হন। পাশাপাশি ফার্সি পড়াতেন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে। কিন্তু কর্মক্ষেত্রের চেয়েও বড় বদল ঘটে গিয়েছিল তাঁর অন্তর্জগতে। এতটাই বদল, যে, তাঁর পরিচয় হয়ে দাঁড়ায় চার্লস হিন্দু স্টুয়ার্ট। সাহেব একদিকে চাকরি করতেন ব্রিটিশ প্রশাসনের উঁচু পদে, আরেকদিকে গঙ্গাস্নান, পুজো-আচ্চা, শাস্ত্র পড়া, কোনও কিছুই বাদ যেত না তাঁর। হিন্দু ধর্ম ও দর্শনের প্রতি গভীর আকর্ষণ ছিল তাঁর। ভারতীয় ধর্মশাস্ত্র, ইতিহাস, পুরাণ, প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে রীতিমতো চর্চা করতেন তিনি। তাই অনেকে তাঁকে ‘পণ্ডিত’ বলেই সম্বোধন করতেন। ভারতীয় পুরাতত্ত্বের বিভিন্ন নিদর্শন সংগ্রহ করে বেড়াতেন তিনি। তার মধ্যে অসংখ্য প্রাচীন হিন্দু ও বৌদ্ধ-জৈন মূর্তি, দুষ্প্রাপ্য পুথি, অস্ত্রশস্ত্র, পোশাক, হাতে-আঁকা ছবি, ঐতিহাসিক সামগ্রী, কী নেই! এক ব্রিটিশ অফিসারের রেকর্ড জানায়, স্টুয়ার্টের বাড়িতে তিনি নাকি তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর মূর্তি দেখেছিলেন।
আরও শুনুন: বাঙালি খানসামার সঙ্গে মহারানির ‘বিশেষ’ সম্পর্ক, তোলপাড় পড়েছিল বিশ্বে
তবে প্রাচীন দেবমূর্তি নয়, সাহেবের সবচেয়ে প্রিয় ছিল গোপালের একটি বিগ্রহ। গঙ্গাস্নানে যাওয়ার সময় নিজের সঙ্গে গোপালের মূর্তিটিকেও নিয়ে যেতেন সাহেব। নিষ্ঠার সঙ্গে গোপালের নিত্যপূজা করতেন তিনি। শোনা যায় মৃত্যুর সময়েও গোপালকে কাছছাড়া করেননি সাহেব। আর হিন্দু দর্শনের প্রতি তাঁর যে প্রগাঢ় আগ্রহ ছিল, তা প্রভাব ফেলে গিয়েছে তাঁর সমাধিসৌধেও। যেন মনে করিয়ে দিয়েছে, এমনই বৈচিত্র্য ধারণ করে আছে এই দেশ।