ভারতে ঐতিহাসিক স্থাপত্য ভাস্কর্যের ছড়াছড়ি। কিন্তু তার সবগুলোই রাজা বাদশারা বানিয়েছেন বললে ভুল বলা হবে। রানিদের, কিংবা প্রভাবশালী মহিলাদের অবদানও তাতে কম নেই। আসুন, শুনে নেওয়া যাক সেরকমই কিছু ঐতিহাসিক নিদর্শনের কথা।
ভারতবর্ষে মেয়েরা কখনও রাজা হয়নি। হয়েছে রাজার বউ আর প্রজার বউ। এ কথা স্পষ্টই বলেছিলেন নারীবাদী কবি মল্লিকা সেনগুপ্ত। সত্যি বলতে, ইতিহাসের পাতা ওলটালে এ কথার বিরুদ্ধে বলার মতো যুক্তিও বিশেষ মেলে না। সেখানে পাতায় পাতায় ছড়ানো রাজারাজড়া নবাব বাদশাহদের মহান কীর্তি। অথচ এসবের মধ্যেও কয়েকজন প্রভাবশালী মহিলা যে নিজেদের কীর্তি স্থাপন করে যেতে পেরেছিলেন, সেইসব চিহ্ন যেন কেউ মনেই রাখেনি সেভাবে। এ দেশ জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে যত অপরূপ স্থাপত্য, তার একটা অংশের কৃতিত্ব কিন্তু তাঁদেরও। আসুন, ইতিহাসের ধুলো সরিয়ে ফিরে তাকানো যাক সেদিকেই।
আরও শুনুন: প্লেগ থেকে স্প্যানিশ ফ্লু, বারেবারে এসেছে মহামারী, লড়াই করে ঘুরে দাঁড়িয়েছে মানুষ
তাজমহল দেখেননি এমন লোক বোধহয় হাতে গুনে পাওয়া যাবে। আর প্রিয়তমা বেগম মমতাজমহলের স্মৃতিতে ভারতসম্রাট শাহজাহানের তাজমহল বানানোর গল্প? সে কথা কারোরই অজানা নয়। কিন্তু ইতমাদ-উদ-দৌলার সমাধি? তার নামই বা শুনেছেন কজন? স্থানীয় লোকেদের মুখের ভাষায় তার নাম অবশ্য ‘বেবি তাজমহল’। কারণ মনে করা হয়, পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম যে তাজমহল, তার অসাধারণ স্থাপত্যের অনুপ্রেরণা এসেছিল আগ্রার ইতমাদ-উদ-দৌলার সমাধি থেকেই। ১৬২২ থেকে ১৬২৮ খ্রিস্টাব্দ, এই ছ-বছর ধরে গড়ে উঠেছিল এই সমাধিসৌধটি। পিতা মির্জা গিয়াসউদ্দিন বেগ ওরফে ইতমাদ-উদ-দৌলার স্মৃতির উদ্দেশে এই সৌধ গড়ে তোলার নির্দেশ দিয়েছিলেন জাহাঙ্গিরের প্রিয়তমা বেগম, ভারতসম্রাজ্ঞী নূরজাহান।
মুঘল যুগের দিকে তাকালে এমন উদাহরণ ভূরি ভূরি মিলতে পারে। যেমন ধরা যাক দিল্লির খায়ার আল-মানাজিল (Khayr al-Manazil) মসজিদটির কথা। এই ঐতিহাসিক মসজিদটি ১৫৬১ সালে তৈরি হয়েছিল। তবে কোনও নবাব কিংবা বেগমের নির্দেশে নয়, মহামতি আকবরের দুধ-মা এবং দরবারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য মাহাম আঙ্গার ইচ্ছেতেই গড়ে উঠেছিল এই মসজিদ।
আরও শুনুন: ৩ বছর আগে মৃত্যু তরুণীর, টের পাননি কেউই, পুলিশ দেখেছিল টিভির সামনে বসে কঙ্কাল…
আকবরের ছেলে হুমায়ুনের সমাধিসৌধ গড়ে তোলার পিছনেও ভূমিকা ছিল এক নারীরই। তিনি হামিদা বানু বেগম, হুমায়ুনের স্ত্রী। দিল্লিতে উদ্যান-সহ যত সমাধিসৌধ দেখা যায়, তাদের সকলের পূর্বসূরি এই লাল বেলেপাথরের সৌধটি। ইরানি স্থপতি মিরক মির্জা গিয়াস-এর নকশা অনুযায়ী নির্মিত এই সৌধটি তাজমহল-সহ আরও অনেক সৌধের নকশায় প্রভাব ফেলেছে।
প্রিয়জনদের সমাধি দেওয়ার পর সৌধগুলি সুন্দরভাবে সাজিয়ে তোলার কথা ভেবেছিলেন এই মুসলিম মহিলারা। সে সুযোগ না থাকলেও হিন্দু রানিরাও পিছিয়ে ছিলেন না। অষ্টম শতকে কর্নাটকে বিরূপাক্ষ মন্দির গড়ে তুলেছিলেন রানি লোকমহাদেবী। শিবের মন্দির হলেও এটি প্রকৃতপক্ষে তাঁর প্রয়াত স্বামী, পল্লব বংশের রাজা দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্যের স্মৃতিতেই নির্মিত। একইভাবে গুজরাটের পাটানে রানি কি ভাভ (Rani Ki Vav) নামের মন্দিরটি গড়ে তুলেছিলেন রানি উদয়মতী। তাঁর স্বামী, সোলাঙ্কি রাজবংশের রাজা প্রথম ভীমের মৃত্যুর পর সরস্বতী নদীর তীরে এই অপূর্ব মন্দির নির্মাণের আদেশ দিয়েছিলেন রানি।
মন্দির মসজিদের বাইরে আরেকটি স্থাপত্যের কথা না বললেই নয়। সেটি প্রকৃতপক্ষে দুর্গ। কর্নাটকের অঘনাশিনী নদীর তীরে মিরজান দুর্গ গড়ে তুলেছিলেন রানি চেন্নাভৈরাদেবী। যিনি স্বয়ং ওই দুর্গে থেকে গোলমরিচ বাণিজ্যের তত্ত্বাবধান করতেন। বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অধীনে থেকে ৫৪ বছর গেরসোপ্পা নামের ওই অঞ্চলটি শাসন করেছিলেন রানি।
ভারতের ইতিহাসে রয়েছেন এই নারীরাও। যাঁরা নিজেদের ছাপ রেখে যেতে জানতেন। তাঁদের না চিনলে অনেকখানি অচেনা রয়ে যায় এই দেশটাই।