একটা ইনিংস। ১৭৫-টা রান। কেবল দলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস মাত্র নয়। গোটা জাতির জন্যে, দেশের ক্রিকেট-ইতিহাসের জন্য সবথেকে তাৎপর্যপূর্ণ বললে ভুল কিছু বলা হবে না। ১৯৮৩-এর বিশ্বকাপে জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে কপিল দেবের সেই মারকাটারি দুরন্ত ইনিংস দেখার কোনও উপায় নেই। কেননা নানা জটিলতায় সেই ম্যাচের সম্প্রচার ছিল বন্ধ। তবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম যে ইনিংসের কথা শুনে এসেছে, শুনতে শুনতে বড় হয়েছে, তার-ই ঝলক এখন দেখা যাবে ’83’ সিনেমায়।
‘খেলোয়াড় হিসাবে তো বটেই, ধারাভাষ্যকার হিসাবেও এর থেকে ভালো ইনিংস আমি আর দেখিনি।’ এই কথা যিনি বলছেন তিনি নিঃসন্দেহে বিশ্ব-ক্রিকেট ইতিহাসের এক স্মরণীয় চরিত্র। সুনীল গাভাসকর। আর যে ইনিংস সম্বন্ধে তিনি এ কথা বলছেন, সেটি হল জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে কপিল দেবের ১৭৫ রানের সেই অদ্বিতীয় প্রতিরোধ, ভারতীয় দলকে যে ইনিংস সেদিন শুধু জেতায়নি, বরং ভারতীয় ক্রিকেটের নয়া অধ্যায় লিখতে শুরু করেছিল।
জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে সেদিন বছর ২৪-এর কপিল যখন মাঠে নামছিলেন, তখন ভারতের ভবিষ্যৎ একরকম অন্ধকারেই বলা যায়। স্কোরবোর্ড দশ রানও ছোঁয়নি, একে একে ফিরে গিয়েছেন তারকা ব্যাটসমানরা। পরাজয়ের ললাটলিখন যেন পড়তে পারছিল গোটা বিশ্বই। এমনিতেও ভারতকে তো বিশ্বকাপ জয়ের দাবিদার হিসাবে ধরা হয়নি সেবার। ফলে বিধ্বস্ত দল হয়েই যে ভারত দেশের মাটিতে ফিরবে, সেই মুহূর্তে যেন এমন একটা নকশাই ফুটে উঠছিল। কিন্তু সাধে কি আর ক্রিকেটকে বলা হয় অনিশ্চয়তার খেলা! সমস্ত সম্ভাবনা আর ফলাফলের ভিতর আগুনে প্রতিরোধ হয়ে দাঁড়ালেন যিনি, তিনি সেদিনের ক্যাপ্টেন- কপিল দেব। তাঁর ব্যাট থেকে আসা ১৭৫ রান শুধু স্কোরবোর্ডের সম্পত্তি হয়ে আর থাকল না, বরং দেশকে দিল এমন এক সাহসের পুঁজি, যা লহমায় বদলে দিয়েছিল ভারতীয় ক্রিকেটকে।
আরও শুনুন: সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে… বিরাটের আগেও অধিনায়কত্ব বিতর্কে বিদ্ধ হয়েছেন এই কিংবদন্তিরা
অথচ দুর্ভাগ্য এমনই যে, সেই ঐতিহাসিক ইনিংসের কোনও ফুটেজ নেই। দেশের উত্তরপ্রজন্ম শুধু তার গল্প শুনেছে, চোখে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। কেন হল না সম্প্রচার? শোনা যায়, হোস্ট ব্রডকাস্টার বিবিসি-তে নাকি চলছিল ধর্মঘট। যেদিন কপিল এই ঐতিহাসিক ইনিংস খেলেন, সেদিন ছিল আরও কয়েকটি ম্যাচ। হাতে লোক কম। কর্তৃপক্ষ তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ইংল্যান্ড বনাম পাকিস্তান আর ওয়েস্ট ইন্ডিজ বনাম অস্ট্রেলিয়া ম্যাচ দুটিরই সম্প্রচার হবে। আবার অন্য মত বলে, স্ট্রাইকের গল্পটাই নাকি ভুয়ো। কর্তৃপক্ষ আসলে ভারতের ম্যাচটিকে পাত্তাই দেয়নি সেভাবে। সেদিনের বিচারে গুরুত্বের নিরিখে অন্য দুটি ম্যাচকেই প্রাধান্য দিয়েছিল বিবিসি। ফলে, অডিও-ভিজুয়াল মাধ্যমে কপিলের ঐতিহাসিক ইনিংসের আর কোনও সাক্ষ্যই থাকল না। অনেকে বলে থাকেন, কেউ কেউ নাকি ব্যক্তিগত ভাবে কিছু অংশ রেকর্ড করেছিলেন। কিন্তু বাস্তবে তার অস্তিত্ব মেলেনি। ফলে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তা শুধু থেকে গিয়েছে রূপকথার গল্প হয়ে।
এতগুলো বছর পর, সিনেমার বাস্তবতায় তার সাক্ষী হতে পারছে ভারতবাসী। কবীর খানের ছবি ‘৮৩’-তে ফিরেছে সেই ম্যাচের স্মৃতি। একটা দিন, যা দেশের ক্রিকেটের রূপরেখাকে বদলে দিয়েছিল, এতদিনে অন্তত তার খানিকটা আঁচ সরাসরি পাচ্ছে এই ২০২১-এর প্রজন্ম। আর যাঁরা সেদিনের ঘটনা জেনেছিলেন শুধু খবর হিসাবে, তাঁরা আজ ডুব দিচ্ছেন নস্ট্যালজিয়ায়। সিনেমা আদতে সত্যি না হোক, সেদিনের সত্যিটুকু তো অন্তত থেকে গেল এই সিনেমাতেই।