বিগ বেন, বাকিংহাম প্যালেস, লন্ডন আই থেকে বেকার স্ট্রিট। রাজার দেশের যেমন রাজকীয় মেজাজ তেমনই নয়নাভিরাম দৃশ্য। সেখানেই বসেছে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালের আসর। পেশার কারণে রাজভূমে পা রেখে নেশার টানে লন্ডনের অলিগলিও ঘুরে দেখলেন রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়। সেই ‘বিলেতযাত্রীর নোটবুক’ থাকল সংবাদ প্রতিদিন শোনো-য়।
ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক মানচিত্র অনুপাতে ইংল্যান্ড আর ফ্রান্সে যতই পার্থক্য থাকুক, সিয়েন আর টেমস ঘোর সমদর্শী! ঠিক যেন ফাটল ধরা পরিবারে দুই তুতো বোন, যারা আপ্রাণ প্রচেষ্টায় কলহ-বিবাদের যাবতীয় আগাছা সমূলে নিঃশেষ করায় ব্রতী। নইলে এত মিল দুইয়ে থাকে কখনও! টেমসের পার ধরে অলস হাঁটতে হাঁটতে আচম্বিতে সিয়েন মনে পড়ে!
প্যারিস ঘুরে এসেছি, বছর সাত হয়ে গেল। বছর সাত পর বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনাল কভার করতে এবার সংক্ষিপ্ত নিবাস ইংল্যান্ড। বাঙালির অতীব সাধের বিলেত ‘মহাশয়’। সিয়েনের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের অনুভূতি নিতে হলে, ট্রোকাডেরো নয়। নামতে হয় প্যাসিতে। সবজে, পুঁচকে স্টেশনের ঘুরপাক সিঁড়ি বেয়ে নেমে, সামনের দোকান থেকে একটা সিগারেট কিনে তার পর ধরিয়ে নিন। নিয়ে, হাঁটুন, স্রেফ হাঁটুন। প্রয়াত সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন, প্যারিসের আস্বাদ নিতে গেলে পদতলই সম্বল হওয়া উচিত। পায়ে-পায়ে হাঁটলে তবে না অনুভব করা যায় একটা শহরের রূপ-রস-গন্ধ, সমগ্র মোহ-মায়া। ঠিক, একদম ঠিক। সিয়েনের কাঁধে হাত রেখে হাঁটলে ফুরফুরে একটা হাওয়া দেয়। প্যারিসের অপার্থিব সৌরভ নাসারন্ধ্রে শিশুলুলভ ঝাপটা মারে। ডান দিকে তাকালে চোখে পড়ে কত শত বৈভবের বজরা, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ক্রুজ’। টিকিট কাটুন, প্রেমিকাকে নিয়ে উঠে পড়ুন, ডিনার করুন। প্রেমের শহরে গিয়ে ও সমস্ত না করাটা অমার্জনীয় এক কথায়, ক্ষমাহীন অপরাধ। এগোতে এগোতে আসে এরপর রাস্তার মোড়, দুই পথ যায় দু’দিকে বেঁকে। বাঁ দিকে এগোলে অতিকায় ট্রোকাডেরো স্টেশন। ঝুপ করে সন্ধে নামলে যেখানে দপ করে বেহালা-বাদ্যির সঙ্গে কপোত-কপোতীর ইচ্ছে-নাচ শুরু হয়ে যায়। যে যেমন পারে, তেমন। যে যে ভাবে পারে, তেমন। ডান দিকে ঘুরে গেলে ভুবনভোলানো আইফেল টাওয়ার। মর্ত্য ছাড়িয়ে যা স্বর্গের দিকে উঠে গিয়েছে। বুকের বাঁ দিক দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে যা, এই পৃথিবীতে প্রেম-প্রদর্শনের চিরশাশ্বত দেবভূমি।
আরও শুনুন: বিলেতযাত্রীর NOTEBOOK: হে গজরাজ! তুমি যে বিলেতে কে তা জানত!
আর কেন কে জানে, শৈশবে পড়া লালকমল-নীলকমলের মতো এই একটা জায়গায় ছবির দেশ, কবিতার দেশের সঙ্গে রাজা-রানির দেশের বড্ড মিল আছে। টেমসকে ডান দিকে রেখে হাঁটলে অবিকল সেই সিয়েনের নিষ্পাপ হাওয়া, সেই খেয়া তরী, চোখ বুজলে সেই দিকশূন্যপুরে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া। টেমসের বাঁ দিকে মস্ত সমস্ত বাড়ি আছে। অমুক হাউস, তমুক হাউস। কার্টুন চরিত্র ‘শ্রেক’-এর একটা পেল্লায় দোকান দেখলাম। পিছন থেকে ততক্ষণে জাপটে ধরে ফিশ অ্যান্ড চিপসের সৌরভ, হু হু হাওয়া অস্থি কাঁপিয়ে ঠেলে নিয়ে যায় সামনে। আরে, সেই তো রাস্তার দু’টো দিক আবার, প্যারিসের মতো। ডান দিকে ঘুরলে আইফেল টাওয়ারের বদলে শুধু ওয়েস্ট মিনিস্টার, বিগ বেনের ‘গং’। পনেরো মিনিট অন্তর যার গুরুগম্ভীর ঘণ্টা-বাদ্যি মনকে দমকা টানে নিয়ে যায় সুদূর অতীতে, ঘোড়ার গাড়ির ভিক্টোরিয়ান বিলেতে। বললে বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, সিয়েন আর টেমস উপকূলবর্তী মেমেন্টো শপের অবস্থান পর্যন্ত এক জায়গায়! ইংলিশ চ্যানেলের ওপারে ফ্রান্সের পতাকা বিক্রি হচ্ছে আর এ পারে ইংল্যান্ডের। যাহ্, তল্লাটের রাজ-ঐশ্বর্যের কথা এতক্ষণ বলাই হয়নি– ‘লন্ডন আই’! কী স্বর্গীয় রূপ তার, কী জমিদারি ঠাটবাট। দু’পাক ঘুরিয়ে সে পর্যটককে সমগ্র লন্ডন দেখিয়ে দেবে, প্যারিসের প্রতি মৃদু নাক সিঁটকিয়ে। কোথায়, একই অঞ্চলে এত স্থাপত্য-সমাহার কোথায় তোমার প্যারিস? তোমার ‘বিগ হুইল’ তো সেই কঁকার্দে, সঁজেলিজের রাজপথ ধরে হেঁটে গেলে! পারলে তুমি? হারাতে পারলে আমায়?
প্রাণ থাকলে টেমস আর সিয়েনে এই কথোপকথন হত নিশ্চয়ই। না, না সংশয় প্রকাশ করছি কেন, আলবাত হত। কে জানে, এখনও হয় কি-না? নদীদের বিশ্বে, কোনও এক মায়া-রাজ্যে। যেখানে দুই নদী পাড়ের মুণ্ডিত-মস্তক গাছ হাওয়ায় শিষ দিয়ে শ্রেষ্ঠত্বের ঝগড়া করে, উদাসী গিটারের টুংটাং যে যার দেশের গর্বকে সমর্থন জোগায়। কিন্তু বেলা শেষে দুই বোনের সমঝোতা হয়ে যায় ঠিক, দেশজ শৈত্যের কাঁটাতার ভুলে, ভালবাসার গ্রন্থিতে বাঁধা পড়ে, শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইকে মুলতুবি রেখে। করবে কী ওরা? সিয়েন বা টেমস, কেউ যে সেরা নয়। সিয়েন আর টেমস–দুই-ই সেরা!