বিয়ের পরও কুমারী জীবনের পদবি ব্যবহার করতে চান কোনও নারী? তার জন্য তাঁর স্বামীর অনুমতি মেলা বাধ্যতামূলক, নির্দেশ দিচ্ছে খোদ সরকার। অর্থাৎ নারীর নিজের নাম নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারটুকু পর্যন্ত এ দেশে প্রশ্নের মুখে, এখনও।
সম্প্রতি নিজের নামের থেকে স্বামীর পদবি ছেঁটে ফেলেছিলেন বলি অভিনেত্রী দিব্যা। সঙ্গে সঙ্গেই জল্পনা ছড়িয়ে পড়ে, তবে কি বিচ্ছেদের পথে হাঁটছেন তারকা? কথা হচ্ছে, কেউ একসঙ্গে থাকবেন কি থাকবেন না, সে কথা আলাদা। কিন্তু বিবাহিতা নারীর নামে স্বামীর পদবি নেই মানেই বিচ্ছেদের সম্ভাবনা, এমনটা ভাবা খানিক অতি সরলীকরণ নয়? তারকাদের ব্যক্তিগত জীবন নাহয় সারাক্ষণ রাডারের আওতায় থাকে, কিন্তু আম মহিলারাও এই অবস্থার বাইরে নন। সোশাল মিডিয়ায় চোখ কান খোলা রাখলেই দেখা যায়, কোনও নারী হয়তো ইউজার নেমে স্বামীর পদবিটি জুড়ে রেখেছিলেন। সেই পদবি ওড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলে অনেকেই বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ দিয়ে রাখেন যে, না, ডিভোর্সের কথা ভাবেননি তাঁরা।
আরও শুনুন: হিজাব বিতর্কের ভারতবর্ষে মনে থাকুক ‘অবরোধবাসিনী’দের হয়ে বেগম রোকেয়ার লড়াই
এই ঘটনাগুলো যে সমাজ মানসিকতা থেকে উঠে আসে, সেই ভাবনাকেই সম্প্রতি স্পষ্ট করে দিয়েছে এক সরকারি নির্দেশ। যা ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, কোনও বিবাহিতা নারীর সঙ্গে তাঁর স্বামীর পদবি জুড়ে থাকারই কথা, সে প্রসঙ্গে নারীর নিজস্ব ইচ্ছে-অনিচ্ছের বিশেষ গুরুত্ব নেই। সম্প্রতি এক মামলার সূত্রে এ কথা সামনে এসেছে যে, কোনও বিবাহিতা নারী যদি তাঁর কুমারী জীবনের পদবিতে ফিরতে চান, তবে তাঁকে স্বামীর অনুমতি দাখিল করতে হবে। কিন্তু কোনও প্রাপ্তবয়স্ক নারীর এইটুকু সিদ্ধান্তও নিজে নেওয়ার অধিকার কেন থাকবে না, সে কথা বুঝে উঠতে পারছেন না অনেকেই।
যে ঘটনার সূত্রে এই বিষয়টি সামনে এল, তার মূলেও রয়েছেন এক দিব্যা-ই। তবে তিনি তারকা নন। ওই যে আমজনতার কথা হচ্ছিল, তিনি তাঁদেরই একজন। দিব্যা মোদি বিয়ের পর স্বামীর টোঙ্গা পদবিটি নামের সঙ্গে জুড়েছিলেন। কিন্তু বিয়েটা যখন টিকল না, তখন সেই পদবি ছাড়তে গিয়েই গোল বেধেছে। ডিভোর্স হলে পর স্বাভাবিকভাবেই ওই পদবি আর ব্যবহার করতে পারবেন না মহিলা। কিন্তু তার আগেই স্বামীর পদবিটি আর বয়ে বেড়াতে চান না বলে পদবি পরিবর্তনের আবেদন জানিয়েছিলেন তিনি। সেখানে সরকারের তরফে সাফ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, পদবি পরিবর্তনের জন্য স্বামীর অনুমতিপত্র বা নো-অবজেকশন সার্টিফিকেট দেখাতে হবে তাঁকে। দিব্যার বক্তব্য, সংবিধান তাঁকে যে ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার দিয়েছে, এই নির্দেশ আসলে সেই অধিকারেই হস্তক্ষেপ করছে। ব্যক্তিস্বাধীনতা কিংবা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার মধ্যে তো নিজের নাম বেছে নেওয়ার স্বাধীনতাও থাকার কথা। কোনও নারীর ক্ষেত্রে সে অধিকার সঙ্কুচিত হবে কেন, প্রশ্ন মহিলার। কোনও প্রাপ্তবয়স্ক নারী ভোটাধিকার পাচ্ছেন, অথচ নিজের জীবনের সামান্য সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার তাঁকে দিতে কুণ্ঠিত এই দেশ?
আরও শুনুন: কখনও ধর্ষণ, কখনও ‘সাজানো ঘটনা’! যা-ই ঘটুক, শিকার সেই মেয়েরাই
সত্যি বলতে, এ দেশের মেয়েদের নাম হারিয়ে যায়। যাওয়াটাই দস্তুর। অমুকের বউ কিংবা তমুকের মা হয়েই এ দেশে বেঁচে থাকেন হাজার হাজার নারী। আর পদবি? একসময় এ দেশের মেয়েদের আলাদা করে পদবির উল্লেখই থাকত না। ব্রাহ্মণ পরিবার হলে দেবী আর অব্রাহ্মণ হলে দাসী লিখেই কাজ চলে যেত। এখন সে পরিস্থিতি হয়তো খানিক বদলেছে। তবুও, বাবার পদবিই বর্তায় সন্তানের উপর, মায়ের নয়। আর বিয়ে হলেই স্বামীর পদবিই মেয়েদের পদবি হয়ে দাঁড়াবে, এ নিয়ম তো প্রায় স্বতঃসিদ্ধ। সম্প্রতি এক বাংলা ছবিতেও দেখা গিয়েছিল, শিক্ষিত আধুনিক পরিবারেও এ নিয়ে কতখানি টানাপোড়েন চলে। আসলে মনু যে নারীকে সম্পত্তির মধ্যে গণ্য করেছিলেন, সেই ভাবনাকে এখনও বোধহয় পুরোপুরি বর্জন করে উঠতে পারিনি আমরা। তাই বাবাই হোন, কিংবা স্বামী, একজন মানুষের উপর কী করে কারও মালিকানা আরোপ করা যেতে পারে- এ প্রশ্নটি চাপা পড়ে যায় অনেকসময়েই। নামই তো কোনও মানুষের প্রাথমিক পরিচয়, কিন্তু এ দেশ তার সব মেয়েদের সেই পরিচয়টুকুও এখনও দিয়ে উঠতে পারেনি। না, এ কথায় একটু ভুল হল বোধহয়। পরিচয় অন্য কারও দেওয়ার কথা, নাকি নিজের পরিচয় কী হবে সে সিদ্ধান্ত নিজের হাতেই থাকার কথা আসলে? সেই সিদ্ধান্ত বা সেই নির্বাচনের অধিকারকে দেশ স্বীকৃতি দেবে, এমনটা বলা যেতে পারে বরং। মেয়েদের ক্ষেত্রে সেই অধিকার বরাবরই খানিক টলোমলো। আর সম্প্রতি এই সরকারি নির্দেশ সেই অবস্থানকেই আরও একটু স্পষ্ট করে দিল।