সামাজিকতা সম্পর্কে একেবারে প্রাথমিক ধারণা তৈরির সময়েই একটি মেয়ে বুঝে যায়, দৃঢ়চেতা হতে গেলে তাকে ‘ছেলেদের মতো’ হতে হবে। দেখা যায়, অনেকক্ষেত্রেই ছোট মেয়েরা বলে থাকে, সে বড় হয়ে ছেলে হতে চায়! এমন দাবি কিন্তু কেবল হাসির কথায় সীমাবদ্ধ থাকে না। খুঁটিয়ে দেখলে বুঝতে পারা যায়, কীভাবে লিঙ্গগত বিভাজন একেবারে শৈশবেই প্রভাব ফেলে শিশুদের মানসিক গঠনের উপর।
মানুষ নাকি কাজের জায়গায় পুরুষ ‘বস’ পছন্দ করেন। কারণ বেশিরভাগ মহিলা বসই অত্যন্ত হুকুম চালান, দমিয়ে রাখেন অধস্তন কর্মীদের। আর এমন চাহিদা কেবল পুরুষ কর্মচারীদের নয়, বহু মহিলা কর্মচারীও একমত হয়েছেন এ বিষয়ে। যদিও এ কথা আমরা বলছি না, বলছে সমীক্ষা। কিন্তু যদি বলা যায় যে, এমন আপাত হাস্যকর তথ্যের পিছনে আদতে রয়েছে যুগ যুগ ধরে ঘটে চলা মেয়েদের লিঙ্গ সমতার লড়াই, তাহলে? বিশেষজ্ঞরা বলেন, ছেলেদের মতো হতে চেয়েই নাকি এমন আচরণ করে থাকে মেয়েরা। নিজের অবস্থানের গুরুত্ব বোঝাতে জোর করেই পুরুষসুলভ কঠোরতা আনতে চেষ্টা করে নিজের স্বভাবে।
আসলে ছেলে হোক বা মেয়ে, ছোট থেকেই বাড়ির বড়রা শিশুদের শিখিয়ে দেয় যে যা কিছু দুর্বল, নড়বড়ে, ভঙ্গুর, তাই নারীসুলভ। তাই সামান্য বিষয়ে ঝগড়া করলে ‘মেয়েছেলে’ বলে কটূক্তি করা যায়। কোনও কাজে অক্ষমতা বোঝাতে সহজেই ব্যবহার করা হয় হাতে চুরি পরে থাকার টিপ্পনি। পরিবারের আর্থিক দায় যদি কোনও মহিলা নিয়ে থাকে, তবে তাকে ‘ম্যান অফ দ্য হাউজ’ বলা হয়। প্রেমের সম্পর্কে যার কর্তৃত্ব চলে বেশি, তার অবস্থান বোঝানো হয় ‘ওয়্যারিং দ্য প্যান্টস্’ শব্দগুচ্ছের সাহায্যে। আর এ জন্যই সামাজিকতা সম্পর্কে একেবারে প্রাথমিক ধারণা তৈরির সময়েই একটি মেয়ে বুঝে যায়, দৃঢ়চেতা হতে গেলে তাকে ‘ছেলেদের মতো’ হতে হবে। দেখা যায়, অনেকক্ষেত্রেই ছোট মেয়েরা বলে থাকে, সে বড় হয়ে ছেলে হতে চায়! এমন দাবি কিন্তু কেবল হাসির কথায় সীমাবদ্ধ থাকে না। খুঁটিয়ে দেখলে বুঝতে পারা যায়, কীভাবে লিঙ্গগত বিভাজন একেবারে শৈশবেই প্রভাব ফেলে শিশুদের মানসিক গঠনের ক্ষেত্রে।
মেয়েটি বড় হতে হতে অনুধাবন করে, তার সামনে দুটি মাত্র পথ খোলা রয়েছে। নয় তাকে অত্যন্ত নারীসুলভ হয়ে উঠতে হবে, যা পুরুষদের চোখে তাকে গ্রহণযোগ্যতা দেবে। সমাজই তাকে লড়িয়ে দেবে অন্য কোনও মেয়ের বিরুদ্ধে। এই যে একটি মেয়ে সজ্ঞানে বা অচেতনেই অন্য কোনও মেয়ের চাইতে সুন্দর হতে চাইছে, সে সবটাই তো কেবল পুরুষের কাছে আকর্ষণীয় হওয়ার লড়াই! আবার তেমনটা যদি সে না হতে চায়, তবে তাকে হতে হবে অত্যন্ত কঠোর। কারণ অন্যের সামনে নুয়ে পড়তে না চাইলে, নিজের জীবনের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে চাইলে, তাকে ‘পুরুষ’ হয়ে উঠতে হবে। নির্লিপ্ত হতে হবে।
তবে এ কথা বললে ভুল হয় যে, এই লড়াই কেবল মেয়েদের। ছেলেরাও ছোট থেকে আপ্রাণ চেষ্টা করে চলে ‘পুরুষ’ হওয়ার। যা কিছু কোমল, সুন্দর, আবেগপ্রবণ, সে সব নিজের চরিত্র থেকে বর্জন করে, একপ্রকার শুদ্ধিকরণের পথ ধরতে হয় তাদের। পরিচিত কোমল স্বভাবের ছেলেটিকে প্রায়শই হেনস্তা করাও তাই ব্যক্তিগত পৌরুষ বৃদ্ধির কাজেই লাগে। কারণ দিনশেষে এ কথা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয় যে, এ সমাজ কেবল ছেলে হয়ে জন্মালেই মান্যতা দেয় না তাকে। সমাজের থেকে সম্মান ছিনিয়ে নিতে চাইলে ছেলেটিকে হতে হয় বিষমকামী, অর্থাৎ ‘হেটেরোসেক্সুয়াল’। নাহলে পৌরুষের বিচারে সেও পিছিয়ে পড়ে যে!