তেরঙ্গা হাতে নিয়ে স্বাধীনতার লড়াইকে পর্দায় ফেরালেন সারা আলি খান। ‘অ্যায় ওয়াতন মেরে ওয়াতন’ ছবিতে তাঁর মধ্যে দিয়েই ফিরলেন এক বীরাঙ্গনাও। কে তিনি? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
যে নেতারা পথ দেখান, তাঁরা সবাই জেলবন্দি। কিন্তু তাই বলে কি লড়াই থমকে যেতে পারে? স্বাধীনতা সংগ্রামের সেই উত্তাল সময়ে এমন আশঙ্কাকে মনেও ঠাঁই দেননি ঊষা। বদলে সেই লড়াইয়ের আগুনকে জাগিয়ে রাখার দায়িত্ব নিয়েছিলেন তিনিই। সরাসরি ময়দানে না গিয়েও যে যুদ্ধ চালানো যায়, সেই পথ দেখিয়েছিলেন তিনি। তাঁর সেই লড়াইকেই এবার পর্দায় ফিরিয়ে আনলেন সারা আলি খান। কান্নান আইয়ার পরিচালিত ‘অ্যায় ওয়াতন মেরে ওয়াতন’ ছবিতে ঊষা মেহতার ভূমিকায় দেখা গিয়েছে তাঁকে। তাঁর হাতে বন্দুক নেই, বদলে রয়েছে মাইক্রোফোন। তা-ই যেন হয়ে উঠেছে লড়াইয়ের নিশান, স্বাধীনতার পতাকা। আসলে এই অন্য পথেই তো স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিয়েছিলেন বম্বের তরুণী ঊষা মেহতা।
কে ছিলেন এই বীরাঙ্গনা?
আরও শুনুন:
যৌনাঙ্গে লঙ্কাবাটা ঢুকিয়ে দেয় ব্রিটিশ পুলিশ, তবুও হার মানেননি প্রথম মহিলা রাজবন্দি ননীবালা
১৯২০ সালের ২৫ মার্চ, গুজরাটে জন্মেছিলেন ঊষা মেহতা। জানা যায়, আইনের ছাত্রী ঊষা বরাবরই শ্রদ্ধা করতেন মহাত্মা গান্ধীকে। আইনব্যবসা তাঁদের বংশগত, বাবাও ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের জেলা জজ। কিন্তু তা হলে কী হবে, দেশের স্বাধীনতার জন্য সরব হতে তাঁরা ভয় পাননি। মা-বাবাকে দেখেই ছোট থেকেই একই পথে হাঁটতে চেয়েছিলেন ঊষা। মাত্র আট বছর বয়সে প্রথমবার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিক্ষোভের শরিক হন তিনিও, যখন ‘সাইমন কমিশন’ নিয়ে উত্তাল দেশ। ‘সাইমন গো ব্যাক’ স্লোগানে গলা মিলিয়েছিল সেদিনের বালিকাও। বড় হয়ে সরাসরি পা বাড়ালেন গান্ধীর পথে। লবণ আইন অমান্যের ডাকে সাড়া দিলেন। এরপর ১৯৪২-এ দেশে আছড়ে পড়ল ভারত ছাড়ো আন্দোলন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিপর্যস্ত ব্রিটিশ সরকার আন্দোলন দমন করতে মরিয়া। গ্রেপ্তার করা হল মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহেরু এবং বল্লভাই প্যাটেল-সহ কংগ্রেসের সমস্ত প্রবীণ নেতাকে। নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হল কংগ্রেসকেও। সেই দমন-পীড়নের মধ্যেও লড়াই জারি রাখার ভার নিলেন তরুণরা। ঊষাও তাঁদেরই একজন।
তিনি ও তাঁর কয়েকজন সহযোগী মিলে শুরু করেছিলেন কংগ্রেস রেডিও। যাতে ব্রিটিশ সরকারের রক্তচক্ষুর পরোয়া না করে সংগ্রামের খবর পৌঁছে দেওয়া যায় গোটা দেশে। দেশের প্রথম রেডিও নেটওয়ার্কের মধ্যে অন্যতম এই কংগ্রেস রেডিও। এমনকি এই রেডিওর মধ্যে দিয়েই পরবর্তী কালে স্বাধীনতার বার্তা দেবেন গান্ধীও। ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সেই অগ্নিগর্ভ দিনে এই রেডিওর দায়িত্ব সামলেছিলেন ঊষা মেহতা। সেসময় সমস্ত নতুন রেডিওর লাইসেন্স বাতিল করছে ব্রিটিশ সরকার। সমস্ত যন্ত্রপাতি সরকারের কাছে জমা না দিলে শাস্তির মুখে পড়তে হচ্ছে। এই অবস্থাতেও বাবুভাই খাকর, বিটলভাই জাভেরি ও চন্দ্রকান্ত জাভেরিকে নিয়ে গোস্ট ট্রান্সমিটার বসিয়েছিলেন ঊষা। আর তার মাধ্যমেই তিনি চালিয়ে গিয়েছিলেন খবর সরবরাহের কাজ। চট্টগ্রাম বোমা হামলা থেকে জামশেদপুরের বন্ধ, দেশের নানা প্রান্তের সংগ্রামের সত্যি খবর প্রকাশ করতেন তাঁরা। যে সময়ে খবর জানার বেশি সুযোগ নেই, সংবাদপত্র আর রেডিওর উপরেও নানাভাবে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে, সেসময়ে এর গুরুত্ব আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
ঊষা পরে বলেছেন, একদিন যখন বন্দেমাতরমের রেকর্ড চাপাচ্ছেন, সেসময় দরজায় শোনা গেল আঘাতের শব্দ। দেখা গেল বিশাল পুলিশবাহিনী বাড়ি ঘিরে ফেলেছে। অফিসার ধমক দিলেন, রেকর্ড বন্ধ করুন। সমস্ত জোর গলায় এনে ঊষা পালটা জবাব দিলেন, এ গান আমাদের জাতীয় গান। আপনারা বরং এ গানকে সম্মান করে দাঁড়িয়ে থাকুন।
আরও শুনুন:
গৃহবধূ থেকে বিপ্লবী, অস্ত্র আইনে প্রথম সশ্রম কারাদণ্ড হয় দুকড়িবালা দেবীর
যে তরুণী পুলিশের বন্দুকের মুখে এমন কথা বলতে পারেন, তাঁকে ভয় দেখাবে কে! দীর্ঘ তদন্ত আর বিচারের পর জেল হয়েছিল ঊষার। ১৯৪৬ সালের মার্চ পর্যন্ত দিন কেটেছিল কারাগারেই। বাপুর ‘করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে’-র কথা মানতে পেরেছেন, এই আনন্দেই কারামুক্তির পর মাথা উঁচু করে ফিরেছিলেন ঊষা।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নতুন করে পড়াশোনা শুরু করেন ঊষা মেহতা। গবেষণা করেন গান্ধীর আদর্শ নিয়েই। দীর্ঘকাল অধ্যাপনা করেছেন তিনি। তাঁকে ভূষিত করা হয়েছে পদ্মবিভূষণ সম্মানে। এবার সেই মহীয়সী নারীর জীবনকেই পর্দায় রূপ দিলেন সারা।