যৌন হেনস্তা। ভয়ংকর দুটি শব্দ। শিশুরাও রেহাই পাচ্ছে না এর হাত থেকে। তাদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য আগাম কী সতর্কতা নেওয়া যেতে পারে? জানালেন, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ রিমা মুখোপাধ্যায়।
সাম্প্রতিক কালে মাঝে মাঝেই হেডলাইনে উঠে এসেছে কোনও শিশুর ওপর যৌন অত্যাচারের খবর। আমরা হতবাক হয়েছি। শিউরে উঠেছি। গলার কাছে দলা পাকিয়ে গিয়েছে অসম্ভব কষ্ট। আর প্রত্যেকবার, চোখের সামনে ভেসে এসেছে নিজের সন্তান বা খুব কাছের কোনও শিশুর মুখ। সঙ্গে সঙ্গে, যন্ত্রণাকে ছাপিয়ে গিয়ে মনে হয়েছে তাকে আগলে রাখতে হবে যে কোনও মূল্যে। আসুন, শুনে নেওয়া যাক, আমাদের প্রিয় ছোট্ট মানুষদের রক্ষা করার জন্য আমরা কীভাবে সতর্ক হতে পারি।
প্রথমত, ওদের বন্ধু হয়ে উঠুন। কথা বলুন ওদের সঙ্গে। তবে শুধু পড়াশোনা নিয়ে নয়। ওদের রোজকার জীবনে কী চলছে তার খোঁজ নিন। ছোট ছোট প্রশ্ন করে বুঝতে চেষ্টা করুন ওরা কেমন আছে। কাদের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছে ওরা, তার ট্র্যাক রাখুন অবশ্যই। কিন্তু সন্দেহপ্রবণ হয়ে উঠবেন না। তাহলে ওরা কখনোই মন খুলে কথা বলতে পারবে না। মনে রাখবেন, যদি আপনি আপনার সন্তানকে সুরক্ষা দিতে চান, তার জন্য কথা বলার স্পেস খুলে রাখাই সবচেয়ে জরুরি।
দ্বিতীয়ত, দিনের মধ্যে অন্তত একটা সময় ঠিক করে ফেলুন, যে সময়টুকু কেবল আপনাদের দুজনের। আপনার চোখ টিভির পরদায়, কিংবা আঙুল চলছে কিবোর্ডে, আর বাচ্চার কথায় হুঁ হাঁ করে সায় দিয়ে যাচ্ছেন… না। এমনটা করবেন না। ও যে আপনাকে ভরসা করে কোনও কথা বলতে পারে, সেই অনুভবে পৌঁছে দিন ওকে। আর তার জন্য, অন্তত একটা সময়ে, সমস্ত মনোযোগ ওর দিকেই দিন।
তৃতীয়ত, বেবিসিটার হোক কি বাড়ির কাজের লোক, যাচাই করে নিন আপনার বাচ্চা তার সঙ্গে স্বচ্ছন্দ কি না। নতুন স্কুল, প্রাইভেট টিউটর, নাচ-গান-আঁকার ক্লাস, যে কোনও কিছু বেছে নেওয়ার আগেই এই বিষয়টি মাথায় রাখবেন।
চতুর্থ যে কথাটি মনে রাখতে হবে, এখনকার বাচ্চারা কিন্তু যথেষ্ট টেক-স্যাভি। তাদের হাতের কাছে টিভি, স্মার্টফোন, কম্পিউটার, অনেক কিছুই মজুত থাকে। ওদের হাতে গ্যাজেট তুলে দিচ্ছেন বটে, কিন্তু ওরা কী কন্টেন্ট দেখছে সেদিকে নজর রাখতে ভুলবেন না। অনলাইন ক্লাসেও ওরা পড়ার বাইরে কিছু করছে কি না খেয়াল রাখুন।
আরেকটা কাজ করুন। যৌন হেনস্তার কথা মিডিয়াতে প্রায়ই উঠে আসে, আর সবার মতো আপনার শিশুটিও তা দেখতে পায়। এই নিয়ে অহেতুক অস্বস্তিতে পড়বেন না বা এড়িয়ে যাবেন না। বরং ওর সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলুন। জিজ্ঞেস করতে পারেন, ‘এমন কিছু শুনেছ আগে?’ বা ‘তুমি এমন অবস্থায় পড়লে কী করতে?’ ও এই সম্পর্কে কোনও প্রশ্ন করলে সহজ করে তার উত্তর দিন। এতে ওর মধ্যে যৌনতা সম্পর্কে কোনও ভুল ধারণা বা নিষিদ্ধ আকর্ষণ তৈরি হবে না। ওর মনে এই বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা গড়ে দেওয়া কিন্তু আপনারই কাজ, যা ওকে বেড়ে উঠতে সাহায্য করবে।
এর পরেই আসবে ‘গুড টাচ’ আর ‘ব্যাড টাচ’-এর কথা। এই শব্দগুলো আমাদের কাছে এখন বেশ পরিচিত, তাই না? আপনার শিশুটিকেও পরিচয় করিয়ে দিন এদের সঙ্গে। ‘টাচ’, অর্থাৎ স্পর্শ বিষয়টি কিন্তু সবসময়ই খুব গুরুত্বপূর্ণ। হতেই পারে যে আপনার সন্তান গাল টিপে আদর করা পছন্দ করছে না। কিংবা কেউ চুমু খেয়ে আদর করলে সে বিরক্ত হয়। যত কাছের মানুষই হোক, তাকে শেখান স্পষ্টভাবে বিরক্তি প্রকাশ করতে।
মনস্তত্ত্ববিদ ডঃ রিমা মুখার্জি জানাচ্ছেন, যৌন হেনস্থার ফলে বাচ্চার ব্যবহারে নানারকম পরিবর্তন আসতে পারে। যেমন? তিনি বলছেন, বাইট- বাচ্চা চুপচাপ হয়ে যেতে পারে, রেগে যেতে পারে। ভাঙচুর, মারধর, কামড়ানো, বিছানা ভেজানো দেখা যেতে পারে। স্কুল যাওয়া বন্ধ করে দিতে পারে বা যেতে না চাইতে পারে। যে কোনও বয়সের পুরুষকে এড়িয়ে যেতে পারে। ঘুম কমে যেতে পারে, বা ঘুমের মধ্যে আসতে পারে দুঃস্বপ্ন। খাওয়া কমতে বা বাড়তে পারে। কম বয়সেই যৌনতা বিষয়ক জ্ঞান, যা তার থাকার কথা নয়, তাও এসে যেতে পারে।
যৌন হেনস্তার থাবা যে কোথায় এসে পড়তে পারে, তা আমরা কেউই জানি না। হেনস্তার শিকার হলেও, অনেকেই তা সহজে বলে উঠতে পারে না। ভয় পায়, আমাকে কি কেউ বিশ্বাস করবে? কিংবা এর জন্য কি আমাকে শাস্তি পেতে হবে? সুতরাং সতর্ক থাকার পাশাপাশি জেনে নিন এই লক্ষণগুলোও, যাতে ওদের পাশে দাঁড়ানো আপনার পক্ষে সহজ হয়।