নবরাত্রির প্রথম দিনেই পিরিয়ডস। বাড়ির কড়া নির্দেশ, পুজো করা যাবে না। অপমানে, অভিমানে, আত্মঘাতী হলেন গৃহবধূ। এমন কত ঘটনাই হয়তো ঘটে, খবরের আড়ালে রয়ে যায়। কিন্তু পিরিয়ডসের সময় স্নান করে পরিষ্কার পোশাক পরে কেন পুজো করা যাবে না, অঞ্জলি দেওয়া যাবে না, কেন কোনও শুভ কাজে অংশ নেওয়া যাবে না, এর ব্যাখ্যা কোন শাস্ত্রে রয়েছে? প্রশ্ন তুললেন সুলয়া সিংহ।
মহাকাশ থেকে সফলভাবে পৃথিবীতে ফিরেছেন সুনিতা উইলিয়ামস। কানের রেড কার্পেটে নজরকাড়া প্রিয়াঙ্কা চোপড়া। একই অলিম্পিকে জোড়া পদক ঘরে তুলে দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন মনু ভাকের। ২৭ বছর পর দিল্লির মসনদে মহিলা মুখ্যমন্ত্রী রেখা শর্মা। ঋতুস্রাব হওয়ায় নবরাত্রির পুজো করতে বাধা দেওয়ায় আত্মহননের পথ বেছে নিলেন গৃহবধূ! বাকি বিষয়গুলোর সঙ্গে বিষয়টা কেমন বেমামান না?
কিন্তু এই সমাজই তো আমাদের কাছে পরিচিত। যেখানে নারীর সাফল্যের জয়গাথা গাওয়া হলেও মহিলার ঋতুস্রাবের সময়টা হয়ে যায় অচ্ছুত! সভ্যতার এই পর্যায়ে দাঁড়িয়েও খোলামেলাভাবে পিরিয়ডস নিয়ে কথা বললে, তাকে অসভ্যতা বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়। নবপ্রজন্মের ওভার স্মার্ট মেয়েরা নাকি এভাবে পিরিয়ডস নিয়ে আলোচনা করে সমাজের মান ধুলোয় মিশিয়ে দিচ্ছে? আপনিও কি একমত?
প্রশ্ন হল, এই ছুঁতমার্গ এখনও কেন রয়ে গিয়েছে সমাজে? যারা বিষয়টিকে গোপন রাখার নিদান দেন, কেন দেন? তাঁদের যুক্তিটা ঠিক কী? তাঁদের কাছে বিষয়টা অনেকটা যৌনতা গোপন রাখার মতো। সমাজের সেই শ্রেণির মানুষদের মতে, যৌনমিলনও তো মানুষের স্বাভাবিক চাহিদা। তাহলে কি প্রকাশ্যেই সেসব ক্রিয়াকর্ম করা হবে? ঠিক একইভাবে পিরিয়ডসও মহিলাদের গোপন বিষয়। তা বেশ। যাঁরা এমন ধারণায় বিশ্বাসী, তাঁরা মাসের ওই পাঁচটি দিন মহিলাদের সুবিধার্থে ঠিক কী কী করে থাকেন? রান্নাঘর, বাড়ির কাজকর্ম থেকে ছুটি দেওয়া হয় মেয়েদের? বলা হয়, একদিন কোনও ঝক্কি সামলানোর প্রয়োজন নেই? অসহ্য় যন্ত্রণা হলে মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়া হয়? নাহ্, কারণ তাঁরা জানতেই পারেন না, বাড়ির মেয়েদের ঋতুস্রাবের দিনগুলি কখন এসে চলেও গিয়েছে। পুজোপাঠ থেকে ঘরে-বাইরের কাজকর্ম- সব ঠিক ম্যানেজ করে নিয়েছেন মহিলারা।
সব দোষ অবশ্য পুরুষতান্ত্রিক সমাজকে দিলেও চলবে না। যুগের পর যুগ নিজেদের নানা অধিকারের জন্য় তো মহিলারাই লড়েছেন। লজ্জা-দ্বিধা-ভয়কে দূরে ঠেলে ঋতুস্রাব নিয়েও তাঁদেরই কথা বলতে হবে। মহিলাদের স্বাভাবিক এই শারীরিক গঠন এবং চরিত্র নিয়ে আগামীদেরও যে সতর্ক করার দায়িত্ব তাঁদের। পিরিয়ডস সংক্রান্ত কোনও সমস্যায় শরীরে বড়সড় রোগ বাসা বাঁধতে পারে। তাই এনিয়ে আলোচনা জরুরি। মহিলারা মাতৃত্ব নিয়ে গর্বিত। তাহলে পিরিয়ডসে লজ্জা কীসের? তথাকথিত পুরুষদের কাছে বিষয়টি ‘নোংরা’ হলেও বিজ্ঞান তো জানে, ঋতুস্রাব না হলে মাতৃত্বের স্বাদ পাওয়া অসম্ভব!
ঝাঁসির প্রিয়াংশা সোনি নবরাত্রিতে পুজো দেওয়ার জন্য উপোস করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রথম রাতেই পিরিয়ডস হওয়ায় স্বামীর নিষেধাজ্ঞার খাঁড়া নেমে আসে তাঁর উপর। সেই দুঃখ থেকেই চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন তিনি। এমন কত ঘটনাই হয়তো ঘটে, খবরের আড়ালে রয়ে যায়। কিন্তু পিরিয়ডসের সময় স্নান করে পরিষ্কার পোশাক পরে কেন পুজো করা যাবে না, অঞ্জলি দেওয়া যাবে না, কেন কোনও শুভ কাজে অংশ নেওয়া যাবে না, এর ব্যাখ্যা কোন শাস্ত্রে রয়েছে? বলতে পারেন, অম্বুবাচীর সময়টাকেই তাহলে কেন পবিত্র মনে করা হয়? কেন কাতারে কাতারে ভক্ত পুজো দিতে মন্দিরে যান? এসব প্রশ্নের উত্তরদাতাকে খুঁজে না পেলে ঋতুস্রাব নিয়ে প্রয়োজন মতোই আলোচনা করবেন। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের বিশ্বে এহেন বিষয় নিয়ে মহিলাদের তাচ্ছিল্য, অপমানের শিকার হতে হয়! আগামীতেও হয়তো হবে। আর সমাজকে শিক্ষিত করতে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে সেই নারীসমাজকেই।