দু-দশক পেরিয়েও বিলকিস বানো কাণ্ডের নৃশংসতা মুছে যায়নি। ধর্ষকদের কারামুক্তির পরে সে ক্ষতে ঘা লেগেছিল ফের। লাগাতার লড়াইয়ের পর সম্প্রতি সেই মুক্তির নির্দেশ খারিজ করেছে সুপ্রিম কোর্ট। রক্তঝরা এই লড়াইয়ে আরও চার নারীকে তাঁর পাশে পেয়েছিলেন বিলকিস বানো। কারা তাঁরা? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
দীর্ঘ লড়াইয়ের শেষে ধর্ষকদের শাস্তি হতে দেখে খানিক স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিলেন বিলকিস বানো। কিন্তু সে আর কতদিন! স্বাধীনতার অমৃতকালে সেই ধর্ষকেরাই যখন মুক্তি পেল ফের, তাদের মালা পরিয়ে বরণও করে নেওয়া হল, তখন থেকেই আবার নতুন করে লড়াই শুরু হয়েছিল গুজরাটের সেই গণধর্ষিতার। একদিকে স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী সোচ্চারে ঘোষণা করছেন যে এ দেশে নারীর অপমান মেনে নেওয়া হবে না কিছুতেই, অন্যদিকে সেই সময়েই তাঁরই পুরোনো কেন্দ্রে মুক্তি পাচ্ছে নারী-ধর্ষকেরা, এই দুটো ছবি বিলকিসকে সংশয়ে ফেলেছিল। তিনি একা নন, একইরকম সংশয়ে পড়েছিলেন আরও কোনও কোনও নারী। বিলকিসের এই নতুন লড়াইয়ে তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁরাও। প্রায় বছর দেড়েক পর যখন ন্যায় বিচার মিলল বিলকিসের, ফের ওই ধর্ষকদের জেলে যাওয়ার নির্দেশ দিল সুপ্রিম কোর্ট, তার পিছনে এই যৌথ লড়াইয়ের ভূমিকাকে অস্বীকার করার জো নেই।
বিলকিসের লড়াইয়ে সেদিন সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন কারা?
আরও শুনুন: ন্যায়ের জন্য আজীবন লড়াই, সিনেমার স্ট্রাগলের থেকে কম নয় বিলকিসের বাস্তব জীবন
বিলকিসের পক্ষে দাঁড়ানো সেই হাতে-গোনা মানুষের মধ্যে সবার আগে বলতে হবে চারজনের কথা। চারজন নারী। কেউ অধ্যাপক, কেউ সাংবাদিক, কেউ আইনজীবী, কেউ সমাজকর্মী। সমাজের চারটি পৃথক ক্ষেত্রের, চারটি ভিন্ন পেশার মানুষকে জুড়ে দেওয়ার সূত্র ছিল একটিই, বিলকিস বানো গণধর্ষণ মামলা। ২০০২ সালে পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা যে তরুণী বিলকিস ধর্মের নামে গণধর্ষিতা হয়েছিলেন, চোখের সামনে খুন হতে দেখেছিলেন শিশুকন্যা সহ আত্মীয়দের, তাঁকে ন্যায়বিচার দেওয়ার জন্য শেষ পর্যন্ত লড়েছেন এই চার নারী।
তাঁদের মধ্যে ছিলেন ৭৬ বছরের সুভাষিণী আলি। নেতাজির আজাদ হিন্দ ফৌজের ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী সেহগালের কন্যা, বাম নেত্রী সুভাষিণী মনে করেছিলেন ধর্ষকদের মুক্তির চেয়েও বিপজ্জনক সামাজিকভাবে তাদের বরণ করে নেওয়া। এই নারীদের মধ্যে ছিলেন গুজরাট হিংসা নিয়ে চর্চা করে চলা সাংবাদিক রেবতী লাল। বিলকিসের সঙ্গে আগেই সাক্ষাৎ করেছেন তিনি, গুজরাটের ঘটনা নিয়ে ‘দ্য অ্যানাটমি অফ হেট’ নামে একটি বইও লিখেছেন। তাঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন লখনউ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য, ৮০ বছর বয়সি অধ্যাপক রূপরেখা ভার্মা। এর আগে হাথরাস মামলায় সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পানের জামিন হতে রাজি হয়েছিলেন তিনি। নারীর উপর হিংসার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্যই একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও চালান রূপরেখা ভার্মা। গুজরাট সরকার বিলকিস-ধর্ষকদের মুক্তি দেওয়ার পর সুপ্রিম কোর্টে পালটা পিটিশন দায়ের করেছিলেন এই তিন নারীই।
আরও শুনুন: হিজাব বিতর্কের ভারতবর্ষে মনে থাকুক ‘অবরোধবাসিনী’দের হয়ে বেগম রোকেয়ার লড়াই
বিলকিসের এই লড়াইয়ে আরেকজনের কথা না বললেই নয়। এই তিন নারীর পিটিশন দাখিলের পর, লড়াইয়ের পরের অংশটা এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন তিনিই। তিনি বিলকিস বানোর আইনজীবী, শোভা গুপ্তা। তিনি জাতীয় মানবাধিকার সংগঠনের সদস্যও। শুধু এই পর্বে নয়, বিলকিসের দু-দশক ব্যাপী লড়াইয়ে প্রথম থেকেই সঙ্গী হয়েছেন তিনি। নিম্ন আদালত থেকে হাই কোর্ট থেকে সুপ্রিম কোর্ট, গুজরাটের সেই গ্রামের মেয়েটির জন্য আইনের দরজায় ছুটে বেরিয়েছেন ৫৪ বছরের এই আইনজীবী। আর তাঁদের সবার হাত ধরেই, আরও একবার স্বস্তির হাসি হেসে উঠতে পারলেন বিলকিস বানো।