বিলকিস বানোর জয় তাঁর একার নয়, এই জয় আসলে সব মেয়েদেরই। সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক রায়ের পর গুজরাটের গণধর্ষিতার প্রতি সমর্থনের হাত বাড়িয়ে বললেন বিক্ষোভকারী কুস্তিগির বিনেশ ফোগত। আর তাঁর এই কথাই সেতু বেঁধে দিল দেশের দুই বড় নারীকেন্দ্রিক লড়াইয়ের মাঝে। আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
সংখ্যালঘু সাধারণ নারী, কি পদকজয়ী তারকা কুস্তিগির, ক্ষমতার বিরুদ্ধে দাঁড়ালে তাঁরা প্রত্যেকেই আসলে বড় একা। কোনও নারী যখনই নির্যাতনের বিরুদ্ধে মুখ খোলেন, তখনই তাঁকে একঘরে করে দেওয়ার প্রক্রিয়াটি শুরু হয়ে যায়। সেই নিয়তিই মিলিয়ে দিয়েছে বিলকিস আর বিনেশকে। আর তাই, বিলকিস মামলার সাম্প্রতিক সুপ্রিম রায়কে স্বাগত জানালেন বিনেশ ফোগত। সেই জয়ের রেশটুকু সর্বাঙ্গে মেখে নিয়েই যেন, নিজের লড়াই জারি রাখলেন জাতীয় কুস্তিগির বিনেশ।
আরও শুনুন: ন্যায়বিচার পেতেই দীর্ঘ পথচলা, বিলকিসের লড়াইয়ে শামিল ছিলেন এই ৪ নারীও
বিলকিস বানো যখন ন্যায়বিচারের দাবিতে আইনের দোরে দোরে ঘুরছিলেন, তাঁর জন্য কোনও মোমবাতি মিছিল ছিল না। হাতেগোনা কেউ কেউ ছাড়া, তাঁর হয়ে কথা বলার মতো তেমন লোকই বা ছিল কই! তাই বিলকিস জানতেন, তাঁর লড়াই তাঁকে একাই লড়তে হবে। তিনি একে নারী, তায় সংখ্যালঘু। সব দিক থেকেই প্রান্তিক। তাই তিনি গণধর্ষিতা হলেও, তাঁর পরিবারের অন্তত ১৪ জন মানুষ তাঁর চোখের সামনে খুন হয়ে গেলেও, তাঁর দেশের গরিষ্ঠসংখ্যক মানুষ সেভাবে প্রতিবাদে সরব হয়নি। এমনকি তাঁর ধর্ষকরা যখন আইনের ফাঁক গলে মুক্তি পেয়েছে ফের, তাদের বরণ করে নিয়েছে এই সমাজেরই একাংশ। বিলকিস দেখেছেন, বোবা হয়ে গিয়েছেন, ফের উঠে দাঁড়িয়েছেন লড়াই করার জন্য। কারণ, লড়াইটা প্রথমত এবং শেষত, তাঁরই।
কিন্তু এইবার, সে লড়াইয়ে বিলকিস বোধহয় আর পুরোপুরি একা রইলেন না। সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক রায়ে যখন তাঁর ধর্ষকদের জেলে ফেরা নিশ্চিত হয়েছে, বিলকিস ফের খোলা হাওয়ায় শ্বাস নিতে পেরেছেন, সেই সময়ে এসেই তাঁর হাত ধরলেন আরেক নারী। যিনি নিজেও এই নির্যাতনের বিরুদ্ধেই আরেকটা লড়াই লড়ছেন। তাঁর, তাঁদের লড়াইতেও রাষ্ট্র কিংবা আইন কতখানি পাশে আছে তা বলা মুশকিল। তাঁরা ধর্মের বিচারে সংখ্যালঘু নন ঠিকই, কিন্তু লিঙ্গের বিচারে নারী তো সবসময়েই অপর, সবসময়েই প্রান্তিক। হ্যাঁ, বিনেশ ফোগত-রা যতই কুস্তিগির হোন না কেন, পুরুষতান্ত্রিকতা যে তাঁদের পুতুলের মতো দুর্বল বলেই ভাবে, সে কথা তাঁদের হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিয়েছে বিগত বছরখানেক। কুস্তি ফেডারেশনের শীর্ষ কর্তার হাতেই যৌন নিগ্রহের শিকার শিকার একাধিক মহিলা কুস্তিগির, এই অভিযোগে পথে নেমেছিলেন বিনেশরা। একদিন বিশ্বমঞ্চে পদক জেতার পর যে দেশ তাঁদের নিয়ে উল্লাসে মেতেছিল, তাঁদের নির্যাতনের প্রতিবাদে কিন্তু সে দেশকে সেভাবে সোচ্চার হতে দেখা যায়নি। এমনকি সংসদ ভবনের সামনে থেকে যেদিন তাঁদের টেনেহিঁচড়ে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, যেদিন তাঁরা নিজেদের বহুপরিশ্রমে অর্জিত সম্মান ফিরিয়ে দিয়েছেন, সেই সব দিনেও, মুখে কুলুপ এঁটেই থেকেছে বাকি দেশ। সেই একলা হয়ে যাওয়া সময়ে দাঁড়িয়েই এবার বিলকিসের দিকে সহমর্মিতার হাতটুকু বাড়িয়ে দিলেন বিনেশ। বললেন, “আপনি একটা লম্বা যুদ্ধ লড়েছেন বিলকিস। আপনার সে পথের দিকে তাকিয়ে সাহস কুড়িয়ে নিই আমরাও। আপনার এই জয় তাই আমাদের, সব মেয়েদের।”
আরও শুনুন: ন্যায়ের জন্য আজীবন লড়াই, সিনেমার স্ট্রাগলের থেকে কম নয় বিলকিসের বাস্তব জীবন
দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের শেষে বিলকিস তাঁর ধর্ষকদের শাস্তি নিশ্চিত করতে পেরে স্বস্তি পেয়েছিলেন। কিন্তু সে আর কতদিনের! ফের সেই ধর্ষকদের মুক্তি পেতে দেখে থমকে গিয়েছিলেন তিনি। একইভাবে বিনেশরাও আইনি লড়াই, ধরনা, সরকারের কাছে আর্জি- সব পথেই ছুটে বেরিয়েছেন, নিগ্রহকারীর শাস্তি নিশ্চিত করতে। ক্লান্তিকর লড়াইয়ের শেষে যদি বা অভিযুক্ত বিজেপি সাংসদ ব্রিজভূষণকে পদ থেকে সরানো গিয়েছিল, তাঁর নির্বাচনে অংশ নেওয়াও রদ করা গিয়েছিল, কিন্তু ফের নির্বাচনের সোজা পথ ধরেই মসনদ দখল করেছিলেন ব্রিজভূষণ-ঘনিষ্ঠ। বিলকিসের মতোই, হতাশায় ক্ষোভে ডুবে গিয়েছেন বিনেশরাও। তাঁদেরই দেশ যে দেশের মেয়েদের জন্য সহমর্মিতাটুকু দেখাবে না, সে কথা কে-ই বা ভাবতে পেরেছিলেন! কিন্তু এই আঁধার সময়েই সামনে এসেছে বিলকিস মামলার নতুন রায়। যা হয়তো বিনেশদের লড়াইয়ের মশালকেও খানিক উসকে দিয়ে গেল। এক্স হ্যান্ডেলে বিলকিসের উদ্দেশে লেখা খোলা চিঠিতে সেই আশাটুকুই জারি রাখলেন বিনেশ। আর নারীনির্যাতনের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আরেক প্রান্তিক নারীর দিকে তাঁর বাড়ানো হাতটুকু বুঝি এই লড়াইয়ের পথকে একটুখানি সুগম করে তুলল। বিলকিস জানেন, বিনেশও জানেন, লড়াইটা প্রত্যেককে একাই লড়তে হয়। বিশেষ করে মেয়েদের। মেয়েশরীরের ছত্রে ছত্রে নির্যাতন এমন এক অমোঘ নিয়তি হয়ে লেগে আছে, যে, আইন থেকে রাষ্ট্র কেউই তাকে আর বেশি গুরুত্ব দিয়ে উঠতে পারে না। তবুও, সেই পথে এক নির্যাতিতা আরেক নিপীড়িতার দিকে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন, এই বেঁধে থাকাটুকুই বা কম কী!