মুসলিম মহিলাদের খোরপোশ দেওয়ার সুপ্রিম রায় নিয়ে উত্তাল দেশ। কেবল খোরপোশ নয়, এই রায় আসলে মুসলিম মহিলাদের পরিচয় ধরেই টান দিয়েছে। আগে ভারতীয় নাগরিকের পরিচয়, নাকি আগে মুসলিম পরিচয়, কোন পরিচয়ে চিহ্নিত করা হবে তাঁদের? তারই ইঙ্গিত কি দিল এই রায়?
খোরপোশ সংক্রান্ত রায়ে নারীর অধিকার খানিক শক্ত জমি পেয়েছে, এ কথা বলাই যায়। কিন্তু কেবল নারীর অধিকার নয়, নারীর পরিচয় কী হবে, সেই প্রশ্নটিরও যেন একরকম মীমাংসা হয়েছে দেশের শীর্ষ আদালতের এই রায়ে। মূলত মুসলিম নারীর ক্ষেত্রে, অধিকারের পাশাপাশি তার পরিচয়ের প্রশ্নও যেন একটা নতুন দিশা দেখেছে এই রায়ে।
এ কথা বলার কারণ কী? তাহলে পুরো বিষয়টিকেই একটু খতিয়ে দেখতে হয়, অতীত এবং বর্তমান মিলিয়ে।
আরও শুনুন:
তিন তালাকের কফিনে খোরপোশ পেরেক, অধিকার আরও পোক্ত মুসলিম মহিলাদের?
কথা হল, এ দেশে এখনও সবাই একই কেন্দ্রীয় আইনের আওতাভুক্ত নন। মুসলিম সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে পারিবারিক এবং সামাজিক বিষয়গুলির মীমাংসা করে শরিয়ত আইন। সেই আলাদা প্রয়োগের কারণে মুসলিম মহিলাদের বিয়ে সংক্রান্ত আইন বেশ জটিল ছিল। আরও ধোঁয়াশা ছিল তাঁদের অধিকারের প্রশ্নে। তিন তালাকের বলে যে কোনও সময় স্ত্রীকে ঘরছাড়া করার অধিকার ছিল কোনও মুসলিম পুরুষের। উলটোদিকে মহিলাদের যে কোনও সময় ঘর ভেঙে যাওয়ার অনিশ্চয়তা তো ছিলই, আবার ঘরের সঙ্গেই পেটে টান পড়ার পথও খোলা ছিল পুরোপুরিই। যাঁরা কোনোভাবেই আর্থিক উপার্জন করেন না, উপরন্তু যাঁরা দুঃস্থ, সহায়সম্বলহীন; এই দায়দায়িত্বহীন বিচ্ছেদ তাঁদের অন্নসংস্থানের কোনও দিশাও দেখায়নি। এই পরিস্থিতিতে তিন তালাক রদ নিয়ে রাজনীতির যত টানাপোড়েনই থাক, সেই সিদ্ধান্ত মুসলিম মহিলাদের অধিকারের পথেই এক ধাপ এগিয়ে দিয়েছিল। আর এবার চারপতি বি ভি নাগরত্ন ও বিচারপতি অগাস্টাইন জর্জ মাসির ডিভিশন বেঞ্চের রায় এ কথাও জানাল যে, দেশে যে খোরপোশ আইন চালু রয়েছে, তা সমস্ত ধর্মের মহিলাদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। সুতরাং বিবাহবিচ্ছেদ হলে খোরপোশ চাইতে পারবেন মুসলিম মহিলারাও। এমনকি সে বিচ্ছেদ তিন তালাকে হলেও। তিন তালাক নিষিদ্ধ করার পর, এই খোরপোশের আইনি নির্দেশ মুসলিম নারীদের অধিকারের জমিটি একটু শক্ত করল বলেই মনে হয়।
আরও শুনুন:
খোরপোশ স্ত্রীর অধিকার, ভিক্ষা নয়! মুসলিম মহিলাদের ক্ষেত্রেও একই অবস্থান সুপ্রিম কোর্টের
আর সেখানেই আরও একটি কথাও ভেবে দেখার মতো। কেবল ধর্মে মুসলিম বলেই, মুসলিম ল বোর্ডের নিয়ম মোতাবেক মহিলাদের অধিকারের জায়গাটি এখানে আর খর্ব হচ্ছে না। বরং গোটা দেশেই মহিলাদের জন্য যে ন্যায়বিচারের পথ খোলা রয়েছে, মুসলিম মহিলারাও তার দাবিদার হলেন একইসঙ্গে। ১৯৮৫ সালের শাহ বানো মামলায় তেমনটা হয়নি। ১৯৩২ সালে বিয়ে করা শাহ বানোকে তাঁর স্বামী ১৯৭৫ সালে বাড়ি থেকে বের করে দেন। খোরপোশের দাবিতে শাহ বানো আদালতের দ্বারস্থ হলে আইনজীবী স্বামী সেখানেই তাঁকে তিন তালাক দেন। এ নিয়ে যতই জলঘোলা হোক, আদালত খোরপোশের কথা বললেও শেষ পর্যন্ত শরিয়তি আইন অসহায় শাহ বানোকে সে অধিকার দেয়নি। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের এই রায় সাফ জানিয়ে দিল, কোনও মহিলার ধর্ম যাই হোক না কেন, তিনি দেশের খোরপোশ আইনের আওতায় পড়েন। ফলে আগে ধর্ম নয়, আগে দেশের নাগরিকত্বের পরিচয়টিই এখানে মুসলিম মহিলাদের চিহ্নিত করছে, তাঁদের প্রধান পরিচয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। খোরপোশ নারীর অধিকারের সপক্ষে কথা বলছে ঠিকই, তবে স্বাধীনতার ৭৫ বছর পেরিয়ে নাগরিকত্বের এই স্বীকৃতি যেন মুসলিম মহিলাদের পায়ের তলার জমিকেই শক্ত করল আরও।