দেবী সরস্বতীর মন পাওয়া যে ভারি শক্ত, সে কথা তো জানাই। কিন্তু সাধনায় তাঁরই নাম অর্জন করে নিয়েছিলেন কোনও কোনও নারী। প্রভাবতী দেবী সরস্বতী, পণ্ডিতা রমাবাই সরস্বতী কিংবা সরস্বতী দেবী ছিলেন তেমনই। বাগদেবীর পূজার আবহে শুনে নেওয়া যাক তাঁদেরই কথা, যাঁরা গুণে ছিলেন সরস্বতী, আর নামেও। লিখেছেন রণিতা চট্টোপাধ্যায়।
দেবী সরস্বতী যে রীতিমতো খামখেয়ালি, এক কবিতায় সে কথা লিখে গিয়েছিলেন বুদ্ধদেব বসু। বলেছিলেন, ‘পুজো তাঁকে করতে হবে/ সপ্তাহে সাতদিনই/ তাই বলে যে তুষ্ট হবেন/ তেমন তো নন ইনি।’ কিন্তু যাঁর মন পাওয়া এমন শক্ত, সাধনায় তাঁরই নাম অর্জন করে নিয়েছিলেন কোনও কোনও নারী। বাগদেবীর পূজার আবহে শুনে নেওয়া যাক তাঁদেরই কথা, যাঁরা গুণে ছিলেন সরস্বতী, আর নামেও।
আরও শুনুন:
বাজে গো বীণা… যাঁর হাতে, তিনি এ যুগের বীণাপাণি
সরস্বতী নাম পেয়েছিলেন সেই মেয়েটি, মাত্র ন’বছর বয়সে বিয়ে হয়ে গিয়েছিল যাঁর। শ্বশুরবাড়ি গিয়ে ফেলে-আসা বাড়ির জন্য মনখারাপ করায় বাঁকা কথা কানে এসেছিল। মুহূর্তে নতুন বাড়ি আর সম্পর্ক, দুই-ই ছেড়ে সে ফিরে এসেছিল পুরোনো ঠিকানায়। তবুও, স্কুলের গণ্ডি পেরোতে না-পারা সেই মেয়েটি, লিখেছিলেন তিনশোরও বেশি বই। এমনকি বাংলা সাহিত্যে প্রথম মেয়ে গোয়েন্দার জন্মও তাঁরই হাতে। কে জানে, নারীর অনাশ্রয় আর সহায়হীনতার ইতিহাসকে নিজের জীবন দিয়ে চিনেছিলেন বলেই কিনা, এমন এক আত্মপ্রত্যয়ী নারীচরিত্র তৈরি করতে পেরেছিলেন তিনি। হ্যাঁ, প্রভাবতী দেবী সরস্বতীর জীবনটাও বোধহয় বইয়েরই মতো। সেই বালিকা বয়সে ঘরে যে সম্মান তিনি পাননি, বাইরের জগৎ তাঁকেই সম্মান, মর্যাদা, খ্যাতি দুহাত ভরে ঢেলে দিয়েছিল পরবর্তী জীবনে। কেবল সারস্বত সমাজেই নয়, রঙ্গমঞ্চ আর চলচ্চিত্রেও ঠাঁই করে নিয়েছিল তাঁর বই। শুধু বাংলায় নয়, অন্যান্য ভাষাতেও। পত্রিকায় তাঁর লেখা উপন্যাসের চাহিদা এমন তুঙ্গে উঠেছিল যে একটি উপন্যাস শেষ হতে না হতেই প্রকাশ করতে হত পরবর্তী উপন্যাসের বিজ্ঞাপন। আর লেখালিখির সূত্রেই নবদ্বীপের বিদ্দ্বজ্জন সভা থেকে ‘সরস্বতী’ উপাধি পেয়েছিলেন তিনি। যোগাযোগ ছিল ঠাকুরবাড়ির সঙ্গেও, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানিত করেছিল ‘লীলা পুরস্কার’-এ। ততদিনে এতখানিই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন প্রভাবতী দেবী, যে, তাঁর নাম নকল করে বাজারে প্রচলিত উপন্যাসের বাড়াবাড়ি রুখতে তাঁকে বিজ্ঞপ্তি দিতে হয়েছিল। এই সময়েই জামশেদপুর নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে যৌথ পরিচালক ছিলেন প্রভাবতী। শ্যামাপ্রসাদই তাঁকে পরামর্শ দেন, নকল সমস্যা থেকে রেহাই পেতে ‘সরস্বতী’ উপাধিটি বরং নামের সঙ্গেই জুড়ে নিন প্রভাবতী।
সরস্বতী উপাধি পেয়েছিলেন পণ্ডিতা রমাবাই-ও। তাও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। মেধাবী কন্যাটিকে শ্রেষ্ঠ ধর্মপ্রচারক করে গড়তে চেয়েছিলেন তাঁর বাবা। তাই এই মারাঠি ব্রাহ্মণকন্যা শৈশব থেকেই হিন্দু ধর্মশাস্ত্র চর্চা করে চলেছিলেন। মাত্র দশ বছর বয়সে অনাথ হয়ে যাওয়ার পরেও সেই জ্ঞানচর্চায় ছেদ পড়েনি। সকলকে মুগ্ধ করতেন স্পষ্ট সংস্কৃত উচ্চারণে। অথচ নারী বলে বেদ-উপনিষদ পাঠের অধিকার মেলেনি তাঁর। সেই কারণেই হয়তো, নারীস্বাধীনতার উচ্চারণ উঠে এসেছিল তাঁর মুখে। আর সেই সামাজিক সচলতার বয়ান তিনি বোধহয় শিখে নিয়েছিলেন মুক্ত বিদ্যাচর্চার পথেই। নারীশিক্ষা প্রচারের জন্য আজীবন কাজ করে গিয়েছেন পণ্ডিতা রমাবাই সরস্বতী।
আরও শুনুন:
সিলেবাসে বসবাস বোরিং, বরং বিভূতিভূষণও পড়ুক সরস্বতীর পড়ুয়া হাঁস
আরও একজন সরস্বতীকে চেনে এ দেশ, যিনি বিদ্যাচর্চার সঙ্গে সে অর্থে যুক্ত নন। ধর্মে হিন্দু নন, ফলে সরস্বতী পূজার সঙ্গে তাঁর সে অর্থে যোগই বা কোথায়! উলটে তিনি সেই সিনেমার জগতের মেয়ে, যাঁদের সেকালে বেশ নিচু চোখেই দেখত সমাজ। তবু, শিল্পের টানেই রক্ষণশীল পার্সি পরিবার থেকে সে জগতে এসে পড়েছিলেন তিনি। জন্মের পর বাবা-মা নাম রেখেছিলেন খুরশিদ। ছোট থেকেই শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে হাতেখড়ি, পরবর্তীকালে পড়াশোনাও করেছেন ধ্রুপদী সঙ্গীতের উপরেই। রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ের সিনেমাজগতে পা দেওয়াটা মোটেও সহজ ছিল না। তাই বিতর্ক এড়াতে নিজের নাম বদলে রেখেছিলেন সরস্বতী দেবী। একবার একটি ঘরোয়া অনুষ্ঠানে তাঁর গান শুনে মুগ্ধ হন বম্বে টকিজের কর্ণধার হিমাংশু রায়। তাঁর হাত ধরেই সঙ্গীত পরিচালনার জগতে পা রাখেন সরস্বতী। তারপর জদ্দান বাই-এর সঙ্গে জুটি বেঁধে ছবিতে সুরনির্দেশনা। আর ফিরে তাকাতে হয়নি তারপর। ভারতীয় সিনেমার প্রথম মহিলা সঙ্গীত পরিচালক বলে গণ্য করা হয় এই জুটিকেই। সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে সরস্বতী দেবীর কাজ কিন্তু আজকের সুরকারদের তুলনায় আরও কঠিন ছিল। কারণ তাঁর সুর করা গান সে সময় যাঁরা গাইতেন, তাঁরা কেউই পেশাদার গায়ক-গায়িকা ছিলেন না। ফলে অভিনেতাদেরই রীতিমতো শিখিয়ে পড়িয়ে নিতে হত তাঁকে। তারপরেও যে নিজের দক্ষতায় বলিউডে পাকাপোক্ত জায়গা করে নিয়েছিলেন সরস্বতী দেবী, তা বোঝা যায় একের পর এক ছবিতে তাঁর সংগীত পরিচালনার সুযোগ পাওয়া থেকেই।
আজকের দিনে এঁদের হয়তো আর সেভাবে মনে রাখিনি আমরা। ‘মেঘ-মল্লার’ গল্পে যেমন হারিয়ে-যাওয়া দেবী সরস্বতীর কথা লিখেছিলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তেমনই বিস্মৃত সরস্বতী হয়েই থেকে গিয়েছেন এই নারীরাও।