শারীরিক বৈশিষ্ট্যের কারণে সহপাঠীদের কটূক্তির শিকার হওয়াই একসময় রুটিন ছিল তাঁর। আর আজ সেই মেয়েই নাকি ভারতের সর্বকনিষ্ঠ সিইও-দের মধ্যে একজন। এই উত্থানও কি এক রূপকথা নয়? আসুন, শুনে নেওয়া যাক রাধিকা গুপ্তার কথা।
স্কুল কলেজে সহপাঠীদের মধ্যে লেগ পুলিং তো চলেই। কিন্তু নির্দোষ ঠাট্টা থেকে তা অনেকসময়ই বাঁক নেয় ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের দিকে। এদিকে সেসব কথা যে অপর পক্ষকে রীতিমতো আঘাত করে, তা বোঝার মতো পরিণতি হয়তো থাকে না ওই পড়ুয়াদের অনেকের মধ্যেই। কিন্তু যে আহত হয়? তার বুকে কাঁটার মতো বিঁধে থাকে সেইসব কটূক্তি। যেমনটা হয়েছিল রাধিকার সঙ্গে। পড়াশোনা করার সময় বারবার সহপাঠীদের কটূক্তির লক্ষ্য হয়ে উঠতেন তিনিই। কারণ, জন্ম থেকেই রাধিকার ঘাড় একদিকে বাঁকা। চিকিৎসার পরিভাষায় যাকে বলা হয় ‘টর্টিকোলিস’। আর এই শারীরিক বৈশিষ্ট্যের কারণেই পড়ুয়াদের ভিড়ের মধ্যে আলাদা করে সকলের চোখ পড়ত তাঁর দিকেই। আর সেই দৃষ্টিতে মিশে থাকত সহানুভূতি নয়, বিদ্রুপ। সেইসব চোখ আর উড়ে আসা কথার টুকরো প্রতিদিন রাধিকার আত্মবিশ্বাস কমিয়ে দিত একটু একটু করে। এমনকি একসময় আত্মহত্যা করতেও গিয়েছিলেন তিনি। দেখা গিয়েছিল, তিনি ততদিনে ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশনের শিকার।
আরও শুনুন: ২০২২-এও বদলায়নি অবস্থা, প্রায় সব ক্ষেত্রেই হাত বাঁধা মেয়েদের, বলছে মানবাধিকার কমিশন
কিন্তু এই সব কিছুই এখন অতীত। অন্যদের অস্বস্তিকর নজর, ব্যঙ্গবিদ্রুপ, কটূক্তি, সবকিছু পেরিয়ে এখন উজ্জ্বল এক জীবনে বাঁচেন রাধিকা গুপ্তা। দেশের সর্বকনিষ্ঠ সিইও-দের মধ্যেও অন্যতম তিনি।
আসলে ‘টর্টিকোলিস’ এমন এক শারীরিক অসংগতি, যেখানে ঘাড়ের পেশিগুলি সংকুচিত হয়ে যায়। আর তার ফলেই মাথা একদিকে হেলে যায়। এই জন্মগত ত্রুটি নিয়েই বড় হয়েছেন রাধিকা। তার উপরে রাধিকার বাবা ছিলেন কূটনীতিবিদ। ফলে তিন বছর অন্তর অন্তর এক দেশ থেকে অন্য দেশে ঠিকানা পালটে যেত তাঁদের। স্কুলে আসা নতুন পড়ুয়াটি এমনিতেই কমবেশি র্যাগিং-এর শিকার হয়, কিন্তু রাধিকার ক্ষেত্রে তা মাত্রাছাড়া হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাঁর মা বেশ সুন্দরী ছিলেন, তাঁর সঙ্গে রাধিকার তুলনা করে ঠাট্টা তামাশা করত সকলে। সব মিলিয়ে রাধিকার আত্মবিশ্বাস তলানিতে ঠেকেছিল। শুধু ছাত্রাবস্থা নয়, অদ্ভুতভাবে কর্মক্ষেত্রেও বাধা হয়ে দাঁড়ায় তাঁর এই শারীরিক অবস্থা। সাতবার চাকরি থেকে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর, মাত্র ২২ বছর বয়সে, আত্মহত্যা করার কথা ভেবেছিলেন রাধিকা।
আরও শুনুন: মণিপুর থেকে কান… কেন নগ্নতাকেই প্রতিবাদের হাতিয়ার করে তোলেন নারীরা?
সৌভাগ্যবশত, সঠিক সময়ে চিকিৎসকের পরামর্শ পেয়েছিলেন তিনি। ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশন কাটিয়ে ফের ফিরে এসেছিলেন জীবনে। আমেরিকাতে একটি চাকরিও পান তিনি। তবে তিন বছর চাকরি করার পর নতুন কিছু করার ইচ্ছে হয় তাঁর। চাকরি ছেড়ে দিয়ে দেশে ফিরে আসেন রাধিকা। কাজ শুরু করেন নতুন সংস্থায়। আর ৩৩ বছর বয়সেই ভারতের সর্বকনিষ্ঠ সিইও-দের তালিকায় নাম লিখিয়ে ফেলেন রাধিকা গুপ্তা।
কর্মক্ষেত্রে আকাশছোঁয়া সাফল্য পেয়েছেন তিনি। কিন্তু তাঁর কাছে এই সবকিছুর চেয়েও বড় সাফল্য নিজেকে নিজের মতো করেই মেনে নিতে পারা। যাঁরা নিজেদের কোনোরকম শারীরিক অসংগতি নিয়ে অস্বস্তিতে থাকেন, তাঁদের সঙ্গে নিজের এই সাফল্যটুকুই ভাগ করে নিতে চান রাধিকা।