ব্যাপারটা খুবই স্বাভাবিক। তবু সেটাকে ঘিরে ট্যাবুর শেষ নেই আজও। হ্যাঁ, কথা বলছি, ঋতুস্রাব নিয়েই। আজও দেশের বহু জায়গায় ওই কটা দিন মেয়েদের কাটাতে হয় নানা ধরনের বিধিনিষেধের মধ্যে। সহ্য করতে হয় নিগ্রহও। এত প্রচার, এত বিজ্ঞাপন সত্বেও বদলায় না সেই জায়গাটা। এবার সেই ট্যাবু ভাঙতেই ভারতে আয়োজন করা হল ‘পিরিয়ড ফেস্টিভ্যাল’ বা ‘মাসিক মহোৎসবের’। ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে সেই উৎসব। কী কী হচ্ছে সেখানে, আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
শুধু গ্রামেগঞ্জে বলে নয়। শহরেরও বহু অংশেও এখনও ঋতুস্রাব নিয়ে হাজার রকম ভ্রান্ত ধারণা, হাজার রকম ট্যাবু। স্যানিটারি প্যাডস ব্যবহার নিয়েও অভাব রয়েছে সচেতনতার। তার সঙ্গে মিশে রয়েছে লজ্জাবোধও। অথচ ঋতুস্রাব যে শুধুই সাধারণ একটা বিষয়, তা নয়, সুস্থতার লক্ষ্মণও। অথচ মাসের ওই কটা দিন বহু জায়গাতেই মেয়েদের বেঁধে ফেলা হয় বিধিনিষেধের দড়িতে। তার সঙ্গে মিশে থাকে বেশ কিছু কুসংস্কারও। সব চেয়ে বড় কথা, এ ব্যাপারটি নিয়ে কথা বলতেই আজও অস্বস্তির মধ্যে পড়েন সমাজের একটা বড় অংশ।
এবার সেই ট্যাবু কাটাতেই ভারতে আয়োজন করা হয়েছে ‘মাসিক মহোৎসব’ অনুষ্ঠানের। বিশ্বের বহু দেশেই প্রথম ঋতুস্রাবকে উদযাপন করার চল রয়েছে। ২০১৭ সাল থেকে এ দেশেও শুরু হয়েছে তেমনই অনুষ্ঠান। মুস ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে গত ২১ মে থেকে শুরু হয়েছে সেই উৎসব। চলবে ২৮ মে পর্যন্ত। ২০১৪ সালে প্রথম বার এমন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে মুস ফাউন্ডেশন। সেখান থেকে চারটি মহাদেশের প্রায় ৯টি দেশে আয়োজন করা হয় এই অনুষ্ঠানের। এ বছর ভারতের সাতটি রাজ্যে উদযাপন করা হয়েছে এই অনুষ্ঠানের। একই সঙ্গে নেপালেও উদযাপিত হচ্ছে এই উৎসব। ব্যাপারটি নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে আফ্রিকাও।
আরও শুনুন: প্রথম প্রযোজনা সংস্থা শুরু থেকে প্রথম সিনেমা পরিচালনা! স্পর্ধার অন্য নাম ফতিমা বেগম
ঋতুস্রাব কী ও কেন, পাশাপাশি সেই সময়ে কী কী ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা উচিত, তা নিয়ে সচেতনতা ছড়ানোই মুস ফাউন্ডেশনের মূল উদ্দেশ্য। তার জন্য আয়োজন করা হয় বিভিন্ন ওয়ার্কশপের। এখনও বহু এলাকাতেই মহিলাদের এ বিষয়ে কথা বলার অনুমতিটুকুও নেই। আত্মীয় স্বজনের সামনে মুখ খোলা তো অনেক দূরের কথা। ঋতুস্রাবকে কেন্দ্র করে সমাজের এই রক্ষণশীল মনোভাবটাকেই পাল্টে দিতে চায় মুস ফাউন্ডেশন।
সমাজের সব ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত সব বয়সের মানুষর একই ছাদের তলায় নিয়ে আসাই লক্ষ্য তাদের। সেখানে না রয়েছে লিঙ্গভেদ, না ধর্ম, শ্রেণী বা জাতির অন্তরায়। প্রথাগত আলোচনার বাইরে গিয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ ভাবে বিষয়টি নিয়ে কথাবার্তার অভ্যাস তৈরি করতে চান মুস ফাইন্ডেশনের কর্মীরা। ব্যাপারটার মধ্যে যে লজ্জাজনক কিছু নেই, সেই বার্তাটুকু ছড়িয়ে দেওয়াই লক্ষ্য এই অনুষ্ঠানের। তাঁদের সঙ্গে এই উদ্যোগে যোগ দিয়েছে আরও বেশ কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন।
আরও শুনুন: ডিঙিয়েছেন বাধার পাহাড়, নিষিদ্ধপল্লী কামাথিপুরা থেকে পড়াশোনার জন্য বিদেশে পাড়ি এই ভারতকন্যার
ঋতুস্রাবকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ভুল ধারনা ভাঙতে আয়োজন করা হয়েছে বিভিন্ন রকম খেলাধুলার। যেগুলোর মাধ্যমেও ছড়ানো হবে এ সংক্রান্ত সচেতনতা। থাকবেন বিশেষজ্ঞেরাও। তাছাড়া ঋতুস্রাবে মেনস্ট্রুয়াল কাপ ব্যবহারের ব্যাপারেও চলবে বিশেষ প্রচার। এখনও বহু প্রত্যন্ত এলাকাতেই স্যানিটারি ন্যাপকিনস ব্যবহারের চল নেই। তার পিছনে সচেতনতার অভাব যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে দারিদ্র এবং অর্থাভাবও। ২০২১-এর একটি সমীক্ষা জানাচ্ছে, রজঃস্বলা হওয়ার পরেই আজও স্কুলছুট হতে হয় বহু মেয়েকেই। দারিদ্রসীমার নিচে থাকা বহু পরিবারের ক্ষেত্রেই এমনটা কোনও বড় ব্যাপার নয়। আর ভারতে সেই সংখ্যা প্রতি বছরে প্রায় এক কোটির কাছাকাছি। তাদের মধ্যে অনেকেরই স্যানিটারি ন্যাপকিনসের মতো মেনস্ট্রুয়াল হাইজিন প্রোডাক্ত কেনার ক্ষমতা নেই। অনেক জায়গায় সেই সব জিনিসপত্র পাওয়াও যায়না। আর কোভিড পরবর্তী সময়ে আরও ভয়ঙ্কর হয়ছে সেই পরিস্থিতি। মুস ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা নিশান্ত বাঙ্গেরার কথায়, শুধুমাত্র স্যানিটারি ন্যাপকিন বণ্টন করলেই সেই সমস্যা পাল্টে যাবে, তেমনটা বোধহয় নয়। মেয়েরা যাতে ঋতুকালীন সময়ে নিরাপদবোধ করতে পারে, সেই ব্যবস্থা নিতে হবে সরকার ও আইনপ্রনেতাদেরই। তার পাশাপাশি মহিলাদের সামনে যেন সবধরনের ঋতুকালীন সরঞ্জামের বিকল্প তুলে দেওয়া যায়, তা-ও নিশ্চিত করতে হবে। আর এই মাসিক মহোৎসব থেকেই তার শুভ মহরৎ হবে বলেই আশাবাদী মুস ফাউন্ডেশনের কর্তাব্যাক্তিরা।