ঘরের মেয়ে থাকবে ঘরেরই ভিতর। কারণ বাইরে পা ফেললে তার জন্য অপেক্ষা করে থাকতে পারে নানান বিপদ। তাই ঘরই শ্রেয়। কিন্তু ঘরেই যদি তাঁর জন্য ওঁত পেতে থাকে বিপদ? কে চোকাবে তার দাম? আর সেই নিয়েই বারবার উঠছে প্রশ্ন। মিলছে কি উত্তর? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
মেয়েদের জন্য নিরাপদ নয় রাতের পথঘাট। তাঁদের জন্য নিরাপদ নয় ট্রাম, বাস। নিরাপদ নয় অফিস কাছারি। কারণ সেসব জায়গায় পদে পদে তাঁদের জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে হিংস্র পুরুষের থাবা। তাই মেয়েদের বাঁচাতে ঘরের কোনেই ঠেলে দেওয়া হয়েছে তাঁদের, শেকলে বাঁধা পড়েছে। কিন্তু ঘরের অন্দরমহলও কি নিরাপদ? সম্প্রতি এমনটাই জানিয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জের একটি প্রতিবেদন। সেখানে বলা হচ্ছে বছরভর বিশ্বজুড়ে যতজন নারীর ওপর নিপীড়ন অথবা হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছে, তার ষাট শতাংশ ঘটেছে তাঁর নিজের বাড়িতে।
নিজের বাড়ি। অতি ছোট্ট দু’টি শব্দ, কিন্তু মেয়েদের ঘর কতটুকু? আদৌ মেয়েরা ঘর খুঁজে পায় কোথাও? মেয়েদের ছোট থেকেই শেখানো হয় সে থাকে তাঁর বাপের বাড়িতে। বিয়ের পর তাঁর আশ্রয় হবে শ্বশুর বাড়ি। অথবা স্বামীর বাড়িই হয়ে উঠবে তাঁর আপন ঘর। অথচ নিজের বাড়িতে নেই তাঁর স্বাধীনতা। তাঁকে মেনে চলতে হয় বাড়ির নিয়মকানুন। তাই নিজের বাড়ির সংজ্ঞাটা মেয়েরা বোধহয় আজও ঠিকমতো জেনে উঠতে পারেনি। অসংখ্য নারীবাদী লেখালেখি, কবিতা, কিংবা গানে মেয়েদের নিজেদের বাড়ি বিষয়টি বহু চর্চিত একটি বিষয়। তাই ছক ভেঙে বহু মেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে, উপার্জনের টাকায় নির্মাণ করেছে নিজের সাধের বাড়ি। যে মেয়ে একা দাঁড়াতে চেয়েছেন, স্বাধীন হতে চেয়েছেন, কারও ছাতার তলায় থাকতে চাননি, তিনি প্রথম চেয়েছেন নিজের বাড়ি। তিনি সাধ করেছেন তাঁর নিজের ঘরের, যেখানে তাঁকে অযথা অনুসরণ করছে না কোনও অদৃশ্য ভয়। গিলছে না তাঁর আত্মপরিচয়। নিঃশেষ করতে চাইছে না তাঁর জীবনীশক্তি। কারণ একটি মেয়ের নিজের ঘর একটি মেয়ের আত্মপরিচয়।
আর তাই আমাদের চোখের সামনে আসছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য। ‘লিঙ্গ হিংসা’ তথা ‘জেন্ডার ভায়োলেন্স’ বিষয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জের উক্ত পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বিগত বছরে পূর্ণবয়স্ক নারী এবং কিশোরীদের মধ্যে প্রায় ৮৫ হাজার খুন এবং নিগ্রহের কথা সামনে উঠে এসেছে। এবং তার মধ্যে ৬০ শতাংশ নির্যাতিতা হেনস্তা কিংবা নিহত হয়েছেন তাঁর বাড়িতেই। শুধু কি তাই? সেই রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতি ১০ মিনিটে খুন হয়ে যান একজন নারী। আরও ভয়ানক তথ্যটি হল, পরিবারের সদস্যদের হাতে নিহত মহিলাদের সংখ্যা লাফিয়ে বাড়ছে। ২০২২ সালে এই সংখ্যা ৪৮ হাজার ৮০০-এর ঘরে থাকলেও, তারপর তা বেড়ে হয়েছে ৫১ হাজার ১০০। শুধু প্রাচ্যের দেশ নয়। নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত তৈরি হয়ে চলেছে পাশ্চাত্যের দেশগুলিতেও। নারীহত্যার দিক থেকে একেবারে পয়লা স্থানে আছে আফ্রিকা। বিগত বছরে সেখানে অন্তরঙ্গ সঙ্গী বা পরিবারের সদস্যদের হাতে খুন হয়েছেন আনুমানিক ২১ হাজার ৭০০ জন নারী। জনসংখ্যার পরিসংখ্যায় এই অংকটি সর্বাধিক। আর তার পরেই রয়েছে মার্কিন মুলুক। বিশ্বের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উন্নত স্থান হলেও বিগত বছরে সেখানে প্রাণ হারিয়েছেন ৮ হাজার ৩০০ জন নারী। মৃত্যুহার গিয়ে ঠেকেছে প্রতি লক্ষে ১.৬ শতাংশ। আর ঠিক এর পরেই রয়েছে এশিয়া। সেখানে প্রতি লক্ষে নারী হত্যার হার যথাক্রমে ০.৮ এবং ০.৬ শতাংশ।
আরও শুনুন: রাতের শহরে মেয়েরা কি নিরাপদ? টুরিস্ট সেজে পথে নেমেই পরখ মহিলা পুলিশের
তাহলে একটি বিষয় খুব স্পষ্ট হয়ে যায়। পিছিয়ে পড়া দেশ হোক, অথবা উন্নয়নশীল দেশ- নারীসুরক্ষায় মহিলা হত্যাকাণ্ড এবং গার্হস্থ্য হিংসা আটকানোতে আজও ততটা শক্ত হাতে রাশ ধরতে পারেনি কেউই। তবে এর মাত্রা দিনের পর দিন ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে রাষ্ট্রপুঞ্জ।
তাই মেয়েদের দুরবস্থা নিয়ে যতই আলোচনা হোক, মহোৎসাহে নারী দিবস পালিত হোক অথবা যৌন হেনস্তার প্রতিবাদে রাজপথে মানুষের ঢল নামুক, তাতে কি এই সুরক্ষা পরিকাঠামোর হাল আদৌ বদলাবে?