গ্ল্যামারের নন্দনকাননে আচমকাই যেন বেহিসেবি ঝড়ের মতো হাজির হলেন জনৈক ইউক্রেনের তরুণী। কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের রেড কার্পেটে দাঁড়িয়ে নিজের ঊর্ধ্বাঙ্গ করলেন অনাবৃত। নগ্নতার বক্ষে ফুটে উঠল তীব্র কয়েকটি শব্দ – ‘আমাদের ধর্ষণ করা বন্ধ হোক।’ মুখেও বললেন সেই কথা। ইউক্রেনে রুশ সেনার অত্যাচারের প্রেক্ষিতে তাঁর নগ্নতাই হয়ে উঠল সপাট প্রতিবাদ। কেন বারবার প্রতিবাদের হাতিয়ার হয়ে ওঠে নগ্নতা? আসুন, ভেবে দেখা যাক।
নগ্ন হয়েছিলেন মণিপুরের মায়েরা। যে নগ্নতার তীব্রতায় দৃষ্টি ঝলসে গিয়েছিল গোটা দেশের। সে-ও ছিল এক ধর্ষণের প্রতিবাদ। যদিও এর উৎস সন্ধানে সময়রেখা ধরে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে আরও অনেকটা। ১৯৭২ সাল। মণিপুরে জারি হয়েছিল ‘আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট’। তার মাত্র দুবছর আগেই জন্ম হয় থাংজাম মনোরমার। ৩২ বছর বয়সে ধর্ষণের কারণে মৃত্যু হয় তাঁর। মনোরমার গুলিবিদ্ধ দেহটি পরীক্ষা করে জানা যায়, ধর্ষণ এবং অমানুষিক নির্যাতনেরও শিকার হয়েছিলেন মণিপুরি মেয়েটি। অভিযোগের আঙুল ওঠে ভারতীয় আধাসামরিক ইউনিট, ১৭ অসম রাইফেলস-এর দিকে। মনোরমার মৃত্যুর প্রতিবাদে মণিপুরের কাংলা দুর্গে অসম রাইফেলসের সদর দপ্তরের সামনে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন সেখানকার জননীরা।
আরও শুনুন: ‘জঙ্গল ছোড়ব নাহি’… হাতে তির-ধনুক, অরণ্য রক্ষায় একজোট প্রমীলাবাহিনী
২০০৪ সালের ১১ জুলাই যখন মনোরমার মৃতদেহ পড়ে ছিল, তারও চার বছর আগের কথা। বিতর্কিত আফস্পা আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য মঞ্চে নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন সাবিত্রী হেইসনাম। মণিপুরের খ্যাতনামা নাট্যকুশলী দম্পতি কানহাইয়ালাল ও সাবিত্রী রাষ্ট্রের অত্যাচারের প্রেক্ষিতে বেছে নিয়েছিলেন মহাশ্বেতা দেবীর লেখা ‘দ্রৌপদী’ গল্পটিকে। সে গল্পেও প্রতিবাদের হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল নগ্নতা। গল্পটা এরকম, জোতদারের অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার অপরাধে ওয়ান্টেড হয়েছিল খেতমজুর দ্রৌপদী তথা দোপদী আর দুলনা। ধরা পড়ার পর দুলনাকে গুলি করে মারে পুলিশ, কিন্তু সাতাশ বছরের দোপদী যে মেয়ে। তাই অফিসারের নির্দেশে পুলিশরা ‘বানাতে’ লাগল তাকে। অর্থাৎ, নির্দেশ এল গণধর্ষণের। সাতজন অব্দি বোধহয় দোপদীর চোখ খোলা ছিল। তারপরে জ্ঞান হারায় সে। কিন্তু পরদিন সকালে অফিসারের ব্রেকফাস্ট টেবলের সামনে এসে দাঁড়ায় দোপদী মেঝেন। তখন তার গায়ে একটা সুতোও নেই। তার কাপড় যারা খুলে নিয়েছে, তাকে কাপড় পরানোর অধিকার আর তাদের দেবে না দোপদী।
আরও শুনুন: হার মানেননি রক্ষণশীলতার কাছে, সৌদি আরবের প্রথম মেয়ে হিসেবে এভারেস্ট জয় তরুণীর
এ কথা বলতে চেয়েই বোধহয় নগ্নতাকে বারবার প্রতিবাদের পোশাক করে তুলেছেন একাধিক নারী। ব্যবস্থা বা সিস্টেমের হাতে যাঁরা ধর্ষিতা হন, অত্যাচারিতা হয়, রাষ্ট্রের প্রচলিত নিয়মকে অস্বীকার করার মধ্যে দিয়েই প্রতিবাদ ছুড়ে দেন তাঁরা। ঠিক যেমনভাবে নগ্ন হয়ে কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রবেশ করেছেন ফরাসী নারীবাদী সংস্থা ‘এসসিইউএম’-র সদস্য ওই মহিলা। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ইউক্রেনের উপরে লাগাতার আক্রমণ চালাচ্ছে রাশিয়া, আর এই যুদ্ধের ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’ হিসেবে ইতিমধ্যেই ধর্ষিতা অন্তত দশ হাজার মহিলা। এমনকি নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই পায়নি সাত বছরের নাবালিকাও। বিশ্বের দরবারে এই বর্বরতার প্রতিবাদ তুলে ধরতেই নগ্ন শরীরে ইউক্রেনের পতাকার রং বয়ে এনেছিলেন ওই মহিলা। তিনি একা যে এভাবে প্রতিবাদের পথ বেছে নিয়েছেন, তা নয়। ২০০৮ সালে ইউক্রেনেই শুরু হয়েছিল ‘ফিমেন’ গোষ্ঠী। যা মেয়েদের যৌন পণ্য হিসেবে ব্যবহার করা এবং তাদের উপরে হওয়ায় যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে নিয়মিত টপলেস প্রতিবাদের আয়োজন করে থাকে। এর আগে ইরাক যুদ্ধের সময়েও দেখা গিয়েছে প্রতিবাদের এই বিশেষ ধরন। মেয়েদের উপরে ঘটে চলা নির্যাতন ও হিংসার প্রতিবাদে ২০১৭ সালে বুয়েনস আইরেসে প্রেসিডেন্ট ভবনের সামনে বিক্ষোভ দেখান ১০০ জনেরও বেশি নগ্ন মহিলা। ২০১০ সাল নাগাদ, আরব বসন্তের সময় ইসলামিক রাষ্ট্রগুলিতে বাকস্বাধীনতা ও ব্যক্তিস্বাধীনতার পক্ষে সওয়াল করেছিলেন মেয়েরা। নেট দুনিয়ায় আছড়ে পড়েছিল তাঁদের একের পর এক নগ্ন ছবি। এইভাবেই তাঁদের উপরে চাপিয়ে দেওয়া রাষ্ট্রের বাধার দেওয়াল ভাঙতে চেয়েছিলেন ওই মেয়েরা।
যুদ্ধের অনিবার্য ফলাফল হিসেবে আসে মেয়েদের উপরে হওয়া অত্যাচার, পীড়ন, ধর্ষণ। তাই যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনগুলির ক্ষেত্রে বারবারই দেখা গিয়েছে নগ্ন হয়ে প্রতিবাদের ছবি। তা ছাড়া যুক্তি বলে, পোশাক পরাই যেহেতু সভ্য সমাজের শর্ত, ফলে নগ্নতা সহজেই সকলের নজর কাড়ে। সুতরাং প্রতিবাদের যা প্রাথমিক কাজ, নিজের বক্তব্য পৌঁছে দেওয়ার জন্য সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা, তা সাধিত হয় অনায়াসে। ২০২০ সালে পুলিশের হাতে কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েড হত্যার পরবর্তী প্রতিবাদ মিছিলে এই পদ্ধতি অবলম্বন করতে দেখা গিয়েছিল এক তরুণীকে। কেবল মাস্ক ও টুপি পরা এই মেয়েকে গ্রিক দেবী আথেনার নামানুসারে ‘নগ্ন আথেনা’ নাম দিয়েছিল সংবাদমাধ্যম। ২০১৬ সালে এইভাবেই ব্রেক্সিটের প্রতিবাদ জানান এক নগ্ন তরুণী। ‘ব্রেক্সিট ব্রিটেনকে নগ্ন করে দিয়েছে’, খোলা বুকে এ কথা লিখে নিজের নগ্নতার সপক্ষে যুক্তিও দিয়েছিলেন তিনি।
সভ্যতা যখন নিজের সম্মান রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়, তখন সভ্যতার সাজানো নিয়ম ছুড়ে ফেলতে দ্বিধা করা উচিত নয়। মানবতা লাঞ্ছিত হলে, পোশাকের শালীনতা কি আর মানুষকে শ্রেষ্ঠ হিসাবে ঢেকে রাখতে পারে! পণ্যসভ্যতার মুখের উপর তাই বারেবারেই পোশাক ছুড়ে ফেলে দিয়েছেন নারীরা। জানিয়ে দিয়েছেন, নগ্নতা কেবল ফ্যান্টাসি নয়, পুঁজি নিয়ন্ত্রিত সমাজে তা কেবল পণ্যবস্তু নয়, বরং তাই-ই হয়ে উঠতে পারে ধারালো তলোয়ারও। সেই প্রতিবাদী তলোয়ারের সামনে আজও দু-দণ্ড থমকে দাঁড়াতে হয় দুর্বিনীত সভ্যতাকেই।