ভরতমুনি কিংবা বাৎস্যায়নের চোখে ‘গণিকা’ ছিলেন বিদ্যা বুদ্ধি কলা রূপ গুণ সবের সমাহার, কিন্তু বদলে যাওয়া সময়ের বদলে যাওয়া নীতিবোধে গণিকার সেই মান আর নেই। কোনও নারীকে নৈতিকতার দিক দিয়ে অপমান করতেই তখন এই শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে কি এ আসলে আমাদের সমাজের এক প্রাচীন মুদ্রাদোষ! খতিয়ে দেখলেন রণিতা চট্টোপাধ্যায়।
সমুদ্রমন্থনে নাকি উঠে এসেছিলেন দুই নারী। একজন নিদ্রাহীন যৌবনের গানে ব্যাকুল, অন্যজন পবিত্র পূজারিনি। কবির কথায়, “একজনা উর্বশী, সুন্দরী,/ বিশ্বের কামনা-রাজ্যে রানী,/ স্বর্গের অপ্সরী।/ অন্যজনা লক্ষ্মী সে কল্যাণী,/ বিশ্বের জননী তাঁরে জানি,/ স্বর্গের ঈশ্বরী।” অর্থাৎ, এ দেশের প্রাচীন সামাজিক সংস্কৃতিতেই মেয়েদের দুটি শ্রেণি খুব স্পষ্ট রূপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একদিকে ঘরে থাকা মেয়েরা, যাঁরা কুলবধূ বা কুলকন্যা। অন্যদিকে জনপদবধূরা, যাদের পিতৃপরিচয় অস্পষ্ট, আবার কুলকন্যাদের মতো একজন স্বামী থাকার বদলে এঁদের একাধিক প্রণয়ী রয়েছে। সোজা কথায়, পিতা ও পতি যে দুই পরিচয়কে সমাজ নারীর রক্ষক বলে মনে করে, সেখান থেকে বেরিয়ে এঁরা একার পরিচয়ে বাঁচছেন। এবার যে মেয়েরা এই শ্রেণিটিতে পড়েন না, অথচ অন্য শ্রেণির মধ্যে থেকেও যাঁরা তার নিয়মকানুন খানিক ভাঙেন, তাঁদের কী বলা হবে? এ কথা তো বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মেয়েদের পোশাকআশাক, আচার আচরণ, কথাবার্তা, ভাবভঙ্গি সবকিছু নিয়েই একরকম নিয়মবিধি জারি করা আছে সমাজে। সে নিয়ম মেনে চললে তবেই ‘লক্ষ্মী’ মেয়ের তকমা মেলে, এ কথাও জানা। কিন্তু যাঁরা সেই শ্রেণিতে থেকেও ঠিক নিয়ম মেনে লক্ষ্মী হয়ে উঠতে চান না? যাঁরা নিয়মকে খানিক নিজের শর্তে অদলবদল করে নেন, কথায় বার্তায় পোশাকে আশাকে পান থেকে চুন খসতে দেন ইচ্ছে করেই, তাঁদের নিয়েই বাধে গোল। কারণ সমাজের কাছে এই দুই শ্রেণির মাঝামাঝি আর কোনও জায়গা নেই। এদিকে কোনও শ্রেণিতে কাউকে আঁটাতে না পারলেই তার অস্বস্তি বাড়ে। তাই খানিক বিচ্যুতি দেখলেই সে ওই মেয়েদের ‘গণিকা’ বলেই গণ্য করে নিশ্চিন্ত হয়। আর সেখান থেকেই এই ধরনের বক্তব্য আসে যে, কেউ সম্পূর্ণ শরীর ঢাকছে না মানেই সে আসলে দেহপসারিণীদের মতো শরীর দেখিয়ে পুরুষদের আকৃষ্ট করতে চাইছে।
‘বাঙালি জীবনে রমণী’-র এহেন অবস্থান প্রসঙ্গেই নীরদচন্দ্র চৌধুরী বলছেন, “আমাদের দেশে স্ত্রীলোকের জন্য ভদ্রসমাজ ও বেশ্যাসমাজের মধ্যে ‘দোমি-মঁদ’ বলিয়া কোনও জায়গা ছিল না।” কারা এই ‘দোমি-মঁদ’ (demi-monde)? ১৮৫৫ সালে আলেকজান্ডার দ্যুমা যখন এই কথাটি প্রথম ব্যবহার করছেন, তিনি বুঝিয়েছিলেন অভিজাত নাগরিক শ্রেণির এমন একদল নারীকে, কিছু নৈতিক স্খলন রয়েছে বলেই যাঁদের একেবারে লক্ষ্মী মেয়ে বলা চলে না। নীরদচন্দ্র চৌধুরী আরও বলছেন, ধরা যাক কোনও নারীর এমন কেচ্ছা রয়েছে, তারপরেও কিন্তু তিনি দোমি-মঁদ না হয়েও, ইউরোপের অভিজাত সমাজে মর্যাদা রেখে মেলামেশা করতে পারতেন। পোশাক বা আচরণের কথা বাদই থাক, দেখা যাচ্ছে কোনও নারীর একাধিক প্রণয়ী থাকলেও তাঁর মানমর্যাদার হানি হত না। অথচ এখানকার সমাজ যে এই বিষয়ে কতখানি নীতিবাগীশ, সে কথা বলছেন খোদ বঙ্কিমচন্দ্র, “স্ত্রীলোকদিগের উপর যে-রূপ কঠিন শাসন, পুরুষদিগের উপর সে-রূপ কিছুই নাই।” বঙ্কিম বা নীরদচন্দ্র যে সময়ের কথা বলছেন, তখনকার বাঙালি সমাজে ইংরেজি শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে ঢুকে পড়েছে ভিক্টোরিয়ান নীতিবোধ। যে নীতির অণুবীক্ষণে কোনও না কোনও স্খলন ধরা পড়লেই নারীকে প্রায় গণিকার পর্যায়ে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। ভরতমুনি কিংবা বাৎস্যায়নের চোখে ‘গণিকা’ ছিলেন বিদ্যা বুদ্ধি কলা রূপ গুণ সবের সমাহার, কিন্তু বদলে যাওয়া সময়ের বদলে যাওয়া নীতিবোধে গণিকার সেই মান আর নেই। কোনও নারীকে নৈতিকতার দিক দিয়ে অপমান করতেই তখন এই শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে।
কিন্তু সময়ের দিক থেকে আরও যদি খানিক পিছিয়ে যাওয়া যায়? সেকালের ভারতবর্ষে নিপুণিকা, চতুরিকা, মালবিকার কথা তো লিখে গিয়েছেন খোদ কালিদাস। এঁরা সকলেই পুরনারী, কিন্তু সাজসজ্জায় বাকপটুত্বে হাস্যে লাস্যে কুলবধূদের তুলনায় তাঁরা যে বেশ পৃথক তাও স্পষ্ট। নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী বলছেন, “যাদের আমরা উজ্জ্বয়িনীতে দেখেছি তারা সাধারণ শহুরে মেয়ে, চটুল পরিধান, মনোহর ভঙ্গি… মহাকবি কালিদাসের পক্ষপাত বারবারই তাঁদের ওপরে গিয়ে পড়েছে।” এঁদের বলা হচ্ছে নাগরিকা। এ শব্দে কিন্তু কোনও গূঢ় কটাক্ষ নেই। সেকালে নাগরক বা নাগরিক বলতে যা বোঝাত, তাকে এককথায় বলা চলে সফিস্টিকেটেড। বুদ্ধি ও বিদ্যা, রসবোধ ও রুচিবোধ, সবকিছুতেই গড়পড়তা পাঁচজনের থেকে যিনি আলাদা। কবি অমরু বা হাল যে নাগরিকাদের কথা বলেন তাঁরা তুলনায় সংযত, আবার কালিদাসের নাগরিকারা প্রগলভা। নৈষধচরিতের লেখক শ্রীহর্ষ প্রায় বলেই বসেছেন যে, কথায় ব্যঞ্জনা জোগাতে পারেন নাগরিকারাই। নাগরক পুরুষের সঙ্গে মেলামেশাতেও যে এই নারীরা স্বচ্ছন্দ, রত্নাবলী নাটিকায় তার প্রমাণ দিচ্ছেন খোদ রাজা হর্ষবর্ধন। যেখানে বসন্তোৎসবে পিচকারি আর আবির গুলাল ছুড়ে, মৃদঙ্গের তালে নাচতে নাচতে নাগরকদের চমকে দিচ্ছেন পুরকামিনীরা। ওই একই উৎসবে বিলাসিনীদের কথা আলাদাভাবে উল্লেখ করে তিনি এও বুঝিয়ে দিয়েছেন যে এই দুটি শ্রেণি এক নয়। বাণভট্টও নজর করছেন যে এই নাগরিকা শ্রেণির মধ্যে কেউ শীলবতী, কেউ আবার বেশিই সাহসিনী।
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, কখনও প্রশ্রয় কখনও কটাক্ষ থাকলেও, সেকালের কবিরা এই নারীদের নিন্দিতা বলে মনে করছেন না। কিন্তু পরবর্তী কালের সমাজভাবনা এঁদেরই বাঁকা চোখে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। ভিনধর্মের শাসকের শাসনকালে যেমন আঁটসাঁট হয়েছে অন্তঃপুরের গণ্ডি, আরও পরে তাকেই খানিক প্রশ্রয় দিয়েছে ইংরেজিশিক্ষিত পিউরিটান ভাবনার নৈতিকতা। সব মিলিয়ে নারীর দুটি শ্রেণির মধ্যে টানা হয়েছে জলচল ভাগ, মাঝখান থেকে হারিয়ে গিয়েছেন নাগরিকারা। তাঁদের সপ্রতিভতা কেবল নিন্দাই কুড়িয়েছে তখন। সুতরাং, এই সময়ে দাঁড়িয়েও বয়স্কা কোনও নারী যদি সেই চোখেই নারীকে দেখেন, তবে ধরে নেওয়া যায় সেই প্রাচীন মুদ্রাদোষকেই টেনে আনছেন তিনি।