কুম্ভ যেন লিঙ্গসাম্য চর্চার ক্ষেত্রে একটি নতুন দিক খুলে দিচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, একদিকে ধর্মের নামে গোঁড়ামির যে জায়গা সমাজের বুকে আজও জাঁকিয়ে বসে আছে, তা অতিক্রম করা সম্ভব। আবার একটা জনবহুল পরিসরও যে সমষ্টিগত ভাবে মেল গেজ থেকে মুক্ত হতে পারে, তারও দৃষ্টান্ত মিলছে। শুধু মহিলাদের জন্য তা স্বস্তির কারণ নয়; সামগ্রিক ভাবে সমাজের জন্যই তা গুরুত্বপূর্ণ।
কুম্ভ মানেই সন্ন্যাসীদের বিচিত্র আচার-আচারণ। আয়োজন, জাঁকজমক। আধ্যাত্মিকতার চর্চা। বিচিত্র সব দৃশ্যের জন্ম। এবং কখনও সখনও কুম্ভের সঙ্গে জড়িয়ে যায় রাজনীতিও। এবারের কুম্ভও এর ব্যতিক্রম নয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় খানিক বেশি চর্চা হয়েছে বটে। তবে, তা বাদ দিলে কুম্ভের চেনা দৃশ্যে খুব একটা বদল নেই। কিন্তু এই কুম্ভের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকও আছে। যা লিঙ্গসাম্যের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য একটি চর্চার বিষয় বলেই ধরা যায়। যে মেল গেজ ভারতীয় নারীদের পিছু ছাড়ে না, এবং যার দরুন প্রতিদিন নানা অস্বস্তিতে তাঁদের পড়তে হয়, তা থেকে মুক্তি দিয়েছে কুম্ভ। ভিড় সত্ত্বেও দৃষ্টির পুরুষতান্ত্রিকতা থেকে যে মুক্তি সম্ভব, তা যেন বুঝিয়ে দিচ্ছে এই মিলনমেলা।
আরও শুনুন: পরিবার ছেড়ে সন্ন্যাসী, মৃত্যুর পর কীভাবে সৎকার হয় নাগা সাধুর দেহ?
অথচ কোটি মানুষের ভিড়। প্রকাশ্যে স্নান। সব মিলিয়ে দ্বিধা-লজ্জা-ভয়ের প্রবল উপস্থিতিই থাকার কথা। কিন্তু সেখানেই কুম্ভ যেন ব্যতিক্রমী। মেল গেজ আসলে এক ধারণা, যা নারীকে পণ্যায়িত করে। তা একটি ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থারই নির্মাণ। ধর্মীয় অনুষঙ্গের পাশাপাশি কুম্ভ যে বৃহত্তর সাংস্কৃতিক পরিসর নির্মাণ করেছে, সেখানে এই মেল গেজ অনেকাংশেই যেন উবে গিয়েছে। যাঁরা সাধ্বী, তাঁরা দ্বিধাহীন তাঁদের আচার আচারণ পালন করছেন। তাঁরা ছাড়াও, যে মহিলারা কুম্ভে মহাস্নানের জন্য গিয়েছেন, তাঁদেরও এ নিয়ে কোনও সংশয় নেই। বরং অনত্র যে দ্বিধার পর্দা, সতর্কতার চাদর তাঁদের ঘিরে রাখে, এখানে তার বালাই নেই। খুব খোলাখুলি ভাবেই তাঁরা স্নানে অংশ নিতে পেরেছেন। আশেপাশে পুরুষের সংখ্যা কম নয়। আর সমাজের মনস্তত্ত্ব যে রাতারাতি বদলে গিয়েছে তাও নয়। তবে, কুম্ভের পরিবেশই বোধহয় খানিক পরিশীলনের সুযোগ দিয়েছে। যেখানে এই মেল গেজ থেকে মুক্ত হয়েছে প্রতিবেশ।
আরও শুনুন: কুম্ভমেলায় চাহিদা তুঙ্গে গীতা, রামচরিত ইংরাজি অনুবাদের! ধর্মের প্রতি ঝোঁক বাড়ছে জেন-জির?
তীব্র পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ভিতর বসেও কুম্ভ যে এই বিকল্প পরিসর নির্মাণ করতে পেরেছেন, সে বিষয়টি সংবাদমাধ্যমে জানাতেও দ্বিধা করেননি মহিলারা। দেখা যাচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে দল বেঁধে মহিলারাই কুম্ভে গিয়েছেন। ব্যবস্থা যেরকম করা হয়েছে, তাতে তাঁদের অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। সে অসুবিধা কিছু হয়ওনি। কিন্তু এর বাইরেও মহিলারা নানা বিষয়েই সতর্ক থাকেন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নানা বিরূপ আচরণের জন্যই তাঁদের এই সতর্কতা। এ ছাড়া ধর্মীয় স্থানে মহিলাদের প্রবেশ নিয়েও নানা জায়গায় নানা পরতের বিধিনিষেধ দেখা যায়। কোনও কোনও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এ বিষয়ে এতটাই গোঁড়া যে, মহিলাদের প্রবেশের অধিকারের প্রশ্ন রীতিমতো আইন-আদালত অব্দি গড়িয়েছে। কুম্ভও ধর্মীয় পরিবেশই বটে। কিন্তু সেখানে এরকম কোনও ছুঁৎমার্গ নেই। উলটে চেনা পরিবেশেও যে অস্বস্তি বহন করে চলতে হয় নারীদের তা এখানে প্রায় নেই বললেই চলে। মহিলারা জানাচ্ছে, এখানে কেউ তাঁদের জাজ করছে না। কোনও কুদৃষ্টি তাঁদের অনুসরণ করছে না। বরং অচেনা অনেকে যেভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন, তাতে প্রবল ঠান্ডার মধ্যেও আন্তরিকতার উষ্ণতা তাঁরা অনুভব করতে পারছেন। ঠিক এটাই হয়তো কাম্য। কিন্তু সর্বত্র তা মেলে না।
আরও শুনুন: কুম্ভের রাধারানি! ফুল-মালা বিক্রি করতে এসে এবার কুম্ভ মাতালেন ‘কৃষ্ণকলি’
ঠিক এই জায়গাতেই কুম্ভ যেন লিঙ্গসাম্য চর্চার ক্ষেত্রে একটি নতুন দিক খুলে দিচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, একদিকে ধর্মের নামে গোঁড়ামির যে জায়গা সমাজের বুকে আজও জাঁকিয়ে বসে আছে, তা অতিক্রম করা সম্ভব। আবার একটা জনবহুল পরিসরও যে সমষ্টিগত ভাবে মেল গেজ থেকে মুক্ত হতে পারে, তারও দৃষ্টান্ত মিলছে। শুধু মহিলাদের জন্য তা স্বস্তির কারণ নয়; সামগ্রিক ভাবে সমাজের জন্যই তা গুরুত্বপূর্ণ, এবং যে পুরুষরাও পুরুষতন্ত্রের শিকার, তাঁরাও এ থেকে মুক্ত হতেই পেরেছেন। সুতরাং এক ধরনের বিকল্প সাংস্কৃতিক চর্চাই যে সমাজের বুক থেকে পুরুষতন্ত্রের বিষ দূর করতে পারে তা স্পষ্ট। কুম্ভ পেরিয়ে সে বার্তা ছড়িয়ে পড়া জরুরি সমাজের সর্বত্রই।
সুতরাং কুম্ভ মানেই যে কেবল সোশ্যাল মিডিয়ার ভাইরাল ছবি বা ভিডিও তা কিন্তু নয়। বরং যে চিন্তার রসদ কুম্ভের এই পরিসর জোগাচ্ছে, সেই চর্চা এবং অনুশীলন চালিয়ে গেলে আখেরে লাভ এই সমাজেরই।