কেবল সিনেমায় নয়, বাস্তবেও যে সিংহমের মতো সাহসী কোনও পুলিশ অফিসার থাকতে পারেন, সে কথা প্রমাণ করে দিয়েছিলেন অসমের জুনমণি রাভা। পথদুর্ঘটনায় আকস্মিক মৃত্যুর পর ফের চর্চায় উঠে এসেছেন এই লেডি অফিসার। কী কারণে এমন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন তিনি? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
রহস্যজনক ভাবে পথদুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে অসমের জনপ্রিয় পুলিশ অফিসার জুনমণি রাভার। বছর তিরিশ বয়সের এই তরুণী অফিসারের মৃত্যুতে ঘনিয়ে উঠেছে বিতর্ক। অবশ্য জুনমণি নামের বদলে ‘লেডি সিংহম’ নামেই বেশি পরিচিত এই আধিকারিক। জুনমণির কীর্তিকলাপের দরুন অজয় দেবগণের জনপ্রিয় সিনেমার ইস্যু টেনে তাঁকে নয়া নাম দিয়েছিলেন অনুরাগীরা। কেউ কেউ তাঁকে বলতেন ‘দাবাং’ অফিসার। কী কারণে এমন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন তিনি? বলা যাক সে কথাই।
আরও শুনুন: অ্যাসিড হামলায় হারিয়েছে দৃষ্টি, দশম শ্রেণিতে স্কুলের সেরা সেই কিশোরীই
গোটা অসম জুড়েই আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা ছিল জুনমণির। অসমের নগাঁও জেলার সাব-ইনস্পেক্টর ছিলেন তিনি। মরিকলং পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ থাকার সময় থেকেই যেভাবে দুষ্কৃতীদের মোকাবিলা করতেন তিনি, তা প্রায় মিথ হয়ে যায়। ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে তাঁর একটি অডিও ক্লিপ সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে যায়, যেখানে শোনা গিয়েছিল বিজেপি বিধায়ক অমিয় কুমার ভুঁইয়ার সঙ্গে বাদানুবাদ চলছে তাঁর। অবৈধভাবে মেশিন লাগানো নৌকা ব্যবহারের জন্য কিছু জেলেকে আটক করেছিলেন জুনমণি, যারা ওই বিধায়কের এলাকার বাসিন্দা। কিন্তু বিধায়ক তাদের ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দিলে তা মানতে চাননি ‘লেডি সিংহম’। বলাই বাহুল্য, রাজনৈতিক কর্তারা এসব ঘটনা ভালভাবে নেননি। এমনকি তাঁর বিরুদ্ধে মুখ খুলেছিলেন খোদ অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মাও। কিন্তু দুর্নীতির সঙ্গে আপস করতে না চাওয়া, এমনকি রাজনৈতিক নেতাদের কাছেও মাথা না ঝোঁকানো- এইসব ঘটনা থেকেই সাধারণ মানুষের প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন জুনমণি রাভা।
তবে জনপ্রিয়তার পাশাপাশি একাধিক বিতর্কও রয়েছে তাঁকে ঘিরে। আর এই সব কারণেই বারবার খবরের শিরোনামে উঠে এসেছিলেন তিনি। তবে তার মধ্যে সবচেয়ে চমকে দেওয়ার মতো খবর নিঃসন্দেহে নিজের হবু স্বামীকে গ্রেপ্তার করা। জানা যায়, অসমের মাজুলিতে থাকার সময়েই জুনমণির সঙ্গে আলাপ হয়েছিল রানা পোগাগে-র। নিজেকে ওএনজিসি-র জনসংযোগ বিভাগের কর্তা হিসেবে পরিচয় দিয়েছিলেন রানা। আলাপ গড়ায় প্রেমে। ২০২১ সালের ৮ অক্টোবরে ধুমধাম করে তাঁদের বাগদান পর্বও সম্পন্ন হয়। কিন্তু এরপরেই যাকে বলে সিনেমার টুইস্ট। নগাঁওতে বদলি হন জুনমণি। আর সেখানে কাজ করার সময়ই তিনি জানতে পারেন রানার কুকীর্তির কথা। জানা যায়, ওই ব্যক্তি জালিয়াতিতে যুক্ত। শুধু তাই নয়, রানার ব্যাগ তল্লাশি করে ওএনজিসি-র ভুয়ো নথিপত্র এবং সিল পান জুনমণি। রানার সঙ্গে তাঁর যে সম্পর্কই থাকুক না কেন, অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেননি এই পুলিস অফিসার। তাঁর তদন্তের জেরেই পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন রানা, তাঁকে জেল হেফাজতের নির্দেশও দেওয়া হয়।
আরও শুনুন: কেউ যুদ্ধ করেছেন, কেউ সামলেছেন সিংহাসন… ভারতীয় মুদ্রায় কুর্নিশ জানানো হয়েছে যে নারীদের
যদিও কিছুদিন পরেই এই ঘটনায় নয়া মোড় আসে। পুলিশি তদন্তে দুই ঠিকাদারের হদিশ মিলেছিল, যারা রানা-র সঙ্গে আর্থিক লেনদেনে জড়িত ছিলেন। কিন্তু তাঁরা অভিযোগ জানান, তাঁদের সঙ্গে রানার যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিলেন জুনমণিই, এবং তিনিও ওই জালিয়াতিতে যুক্ত। এই টানাপোড়েনে কিছুদিন জেলে থাকতে হয়েছিল লেডি সিংহমকে। বিতর্কের জেরে সাময়িকভাবে সাসপেন্ড হতেও হয়েছিল তাঁকে। পরে অবশ্য তিনি ফের চাকরিতে বহাল হন। এমনকি মৃত্যুর দিনেই জুনমণির বিরুদ্ধে তোলাবাজি সংক্রান্ত একটি মামলা নথিভুক্ত হয়। তার আগের রাতেই জুনমণির সরকারি আবাসে অভিযান চালিয়ে এক লক্ষ নগদ টাকা উদ্ধার করে তা বাজেয়াপ্ত করে অসম পুলিশ। যদিও ওই টাকা জুনমণির মায়ের বলে দাবি করা হয়েছে। জুনমণির এভাবে দুর্ঘটনায় মৃত্যুতেও ষড়যন্ত্রেরই গন্ধ পাচ্ছে তাঁর পরিবার।