কথা ছিল দেবদাসী হওয়ার। তার বদলে সমাজের উচ্চবর্গে নিজের স্থান করে নিয়েছিলেন এই নারী। একদিকে ডাক্তার, আরেকদিকে কট্টর রাজনীতিক তথা ভারতের প্রথম মহিলা বিধায়ক। নারীমুক্তির জন্য অক্লান্ত লড়াই চলেছে তাঁর। ভারত সরকারের পদ্মভূষণ সম্মানেও ভূষিত হয়েছেন তিনি। আসুন, শুনে নেওয়া যাক এই আশ্চর্য নারীর কথা।
জন্মের সময়েই স্থির হয়ে গিয়েছিল তাঁর ভাগ্য। সবাই বলেছিল, দেবদাসী হবে এই মেয়ে। সেই ভাগ্যলিপি মুছে ফেলে নিজের হাতেই নিজের নিয়তিকে নির্মাণ করলেন তিনি। আর কেবল নিজের নয়, আরও অনেক মেয়ের জীবন বদলে দেওয়ার জন্যেই লড়াই চালিয়ে গেলেন নিরন্তর। তিনি, দেবদাসীর কন্যা, মুথুলক্ষ্মী রেড্ডি।
আরও শুনুন: মণিপুর থেকে কান… কেন নগ্নতাকেই প্রতিবাদের হাতিয়ার করে তোলেন নারীরা?
ব্রিটিশ আমলের ভারতবর্ষ। মাদ্রাজে তখন রমরমিয়ে চলছে দেবদাসী প্রথা। দেবতার সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার নামে আজীবন মন্দিরে সেবাদাসী করে রাখা হয় অল্পবয়সি সুন্দরী মেয়েদের। সেই মেয়েদের মধ্যেই একজন ছিলেন চন্দ্রাম্মাল। কিন্তু তাঁর ভাগ্য খানিক আলাদা ছিল বাকি মেয়েদের থেকে। সামাজিক গোঁড়ামির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তাঁকে বিয়ে করেছিলেন মহারাজা কলেজের অধ্যক্ষ নারায়ণস্বামী। যদিও তার দাম চুকাতে হয়েছিল ভালমতোই। সপরিবারে একঘরে হতে হয়েছিল তাঁদের। আর সেই একঘরে সংসারেই জন্ম তাঁদের মেয়ে, মুথুলক্ষ্মীর। সেটা ১৮৮৬ সাল।
মেয়েকে দেবদাসী হিসেবে উৎসর্গ করার জন্য চাপ আসতে লাগল বিভিন্ন দিক থেকে। মেয়েকে বাঁচানোর জন্য অল্পবয়সেই তাঁর বিয়ে দিয়ে দেওয়ার কথা ভাবলেন মা। কিন্তু মুথুলক্ষ্মী যে জীবনের স্রোতে ভেসে যেতে চাননি, বরং স্রোতকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিলেন নিজের হাতে। তাই পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন তিনি। কিন্তু মেয়েদের উচ্চশিক্ষার তখন সুযোগ কোথায়? পুরুষদের জন্য নির্দিষ্ট মহারাজা কলেজেই প্রবেশিকা পরীক্ষায় বসলেন মুথুলক্ষ্মী। আর পরীক্ষায় সগৌরবে উত্তীর্ণ হয়ে ঢুকে পড়লেন সেই কলেজেই। স্বর্ণপদক নিয়ে পাশ করলেন ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা। এরপর মাদ্রাজ মেডিক্যাল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করলেন তিনি। ভারতের প্রথম যুগের মহিলা সার্জনদের অন্যতম মুথুলক্ষ্মী রেড্ডি। ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য তিনিই খুলেছিলেন ‘আদিয়ার ক্যান্সার ইন্সটিটিউট’। চিকিৎসক মুথুলক্ষ্মীর জন্মদিনটিকেই ‘হাসপাতাল দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছে আজকের তামিলনাড়ু সরকার।
আরও শুনুন: হার মানেননি রক্ষণশীলতার কাছে, সৌদি আরবের প্রথম মেয়ে হিসেবে এভারেস্ট জয় তরুণীর
কিন্তু শুধু এইটুকুতেই তাঁর পরিচয় থেমে যায় না। মুথুলক্ষ্মী একদিকে যেমন ছিলেন দক্ষ চিকিৎসক, আরেকদিকে তিনি সামাজিক রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন প্রত্যক্ষভাবে। হয়ে উঠেছিলেন নারী আন্দোলনের অন্যতম মুখ। মহাত্মা গান্ধীর আদর্শে অনুপ্রাণিত এই মহিলা লড়াই শুরু করেছিলেন দলিত মহিলাদের সম্মান রক্ষা করার জন্য। সেসময় অভিজাত পরিবারের সন্তানদের স্তন্যপান করাবার জন্য নিয়োগ করা হত দলিত মহিলাদের। মুথুলক্ষ্মীর চেষ্টাতেই রদ হয় এই প্রথা। পাশাপাশি নিজের বাড়িতেই দলিত, স্বামী পরিত্যক্তা মহিলা, কুমারী মা ও পতিতালয়ের মহিলাদের আশ্রয় দেওয়া শুরু করেন তিনি। সে কারণেই গড়ে তোলেন ‘আভভাই হোম’ নামের একটি আশ্রয়ভবন।
আইন করে দেবদাসী প্রথা রদ করারও চেষ্টা করেছিলেন দেশের এই প্রথম মহিলা বিধায়ক। বাল্যবিবাহ সেসময়ে দেশের অতি সাধারণ ঘটনা। কন্যাশিশুদের বিয়ে দিলে নাকি গৌরীদানের পুণ্য অর্জন করা সম্ভব, এমনটাই বিশ্বাস করতেন অধিকাংশ মানুষ। সেখানে মেয়েদের বিয়ের বয়স যাতে ১৬ করা যায়, আর ছেলেদের ২১, আপ্রাণ সেই চেষ্টাও করেছিলেন মুথুলক্ষ্মী।
সব আন্দোলন তাৎক্ষণিক সাফল্য পায় না। কিন্তু শুরুটা কাউকে করতে হয়। এ দেশে যাঁরা সেই মশাল জ্বালানোর কাজটি করেছিলেন, তাঁদের অন্যতম এই দেবদাসী কন্যা- মুথুলক্ষ্মী রেড্ডি।