দেশের প্রথম মহিলা চিকিৎসক তিনি। যে সময়ে মেয়েদের ঘরের গণ্ডি ডিঙানো বারণ ছিল, সেই সময়ে কালাপানি পেরিয়ে আমেরিকায় গিয়ে ডাক্তারি ডিগ্রি অর্জন করে এনেছিলেন আনন্দীবাই যোশী। যাঁর হাত ধরে আরও এক ধাপ এগোতে পেরেছিল এ দেশের মেয়েদের অবস্থান। আসুন, শুনে নেওয়া যাক তাঁর কথা।
চোদ্দো বছরে মা হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু চিকিৎসার অভাবে মৃত্যু হয় সেই নবজাতকের। সন্তানের অকালমৃত্যুতে সেই কিশোরী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, ডাক্তারি পড়বে সে। যে দেশে কম বয়সে মা হতে গিয়ে অনেক মেয়েই মৃত্যুর মুখে পৌঁছে যেত, কিংবা হারাত সদ্যোজাত সন্তানকেই; সেই দেশের মেয়েদের জন্য, সেই দেশের মানুষের কথা ভেবে চিকিৎসক হতে চেয়েছিলেন আনন্দীবাই গোপালরাও যোশী।
আরও শুনুন: ৯ বছরে বিয়ে, স্বামীর হাতে ধর্ষণের শিকার… তবুও বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মুখ নুজুদ আলি
ব্যাপারটা শুনতে যতখানি সহজ, আদতে তেমনটা নয় মোটেও। কারণ মহারাষ্ট্রের থানে জেলায় আনন্দীবাই ওরফে যমুনার যখন জন্ম হয়, সেটা ১৮৬৫ সাল। দেশ তখন পরাধীন। নেটিভদের পড়াশোনার জন্য কিছু কিছু স্কুল কলেজ খুলেছে বটে, কিন্তু মেয়েদের জন্য উচ্চশিক্ষার আলো দেখা যাচ্ছে না কোথাও। একে তো সমাজের প্রচলিত ধারণা যে মেয়েদের বেশি পড়াশোনা করা অন্যায়, তার উপরে তাদের পড়ার মতো প্রতিষ্ঠানই বা কোথায়! কিন্তু আনন্দীবাই-এর গল্পটা খানিক আলাদা। জেদি মেয়েটিকে সামলে রাখার জন্যই হয়তো, বাবা তাঁকে কিছুটা পড়াশোনা শেখাতে শুরু করেন। তবে সে আর কতদিন! ন’বছর বয়সেই তাঁকে বিয়ে দেওয়া হয় বছর ত্রিশের গোপালরাও যোশীর সঙ্গে। এদিকে ডাক বিভাগের কর্মী গোপালরাও মহারাষ্ট্রের সংস্কার আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন, কিন্তু ইংরেজি জানতেন না বলে তাঁকে প্রায়শই হাসির খোরাক হতে হত। হয়তো সেই ব্যঙ্গবিদ্রুপের পালটা দেওয়ার জন্যই তিনি ঠিক করেছিলেন স্ত্রীকে লেখাপড়া শেখাবেন। শোনা যায়, স্ত্রী পড়াশোনা ফেলে রান্নাঘরে গেলে তিনি তাঁকে মারধর করতেন।
আরও শুনুন: দেবদাসী হওয়ার ভাগ্যলিপি বদলে হলেন চিকিৎসক, দেশের প্রথম মহিলা বিধায়ক তিনিই
আনন্দীবাই-এর চিঠিপত্র থেকে পরবর্তী কালে জানা গিয়েছে, তাঁর পারিবারিক জীবন খুব একটা সুখের ছিল না। তাঁকে লেখাপড়া শেখানোর পিছনে স্বামীর স্বার্থও ছিল। কিশোরী স্ত্রীকে বাড়াবাড়ি রকমের শাসন, এমনকি মারধর পর্যন্ত করতেন গোপালরাও। তবে এসব সত্ত্বেও এ কথা সত্যি, এই সূত্রে সেকালের গড়পড়তা মেয়েদের তুলনায় আনন্দীবাই অন্তত শিক্ষার আলো পেয়েছিলেন অনেকটা বেশি। যার জেরেই ডাক্তার হওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলেন তিনি। কিন্তু এ দেশে তো মেয়েদের ডাক্তারি পড়ার উপায় নেই। গোপালরাও মার্কিন মিশনারি ওয়াইল্ডারকে চিঠি লিখলেন স্ত্রীর পড়াশোনা ও আর্থিক সাহায্যের জন্য। সেই চিঠি ‘প্রিন্সটন’স মিশনারি রিভিউ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হলে নিউ জার্সির থিয়োডিসিয়া কার্পেন্টার নামে এক মহিলা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন। উনিশ বছরের আনন্দীবাই একা কলকাতা থেকে জাহাজে পাড়ি দিলেন আমেরিকায়। ভরতি হলেন পেনসিলভেনিয়া মেডিক্যাল কলেজে।
কিন্তু ইচ্ছেপূরণের দোরগোড়ায় এসে বাধ সাধল স্বাস্থ্য। যক্ষ্মায় আক্রান্ত হলেন আনন্দীবাই। তারপরেও পড়াশোনা চালিয়ে যান তিনি। অবশেষে, ১৮৮৬ সালে ভারতের প্রথম মহিলা ডাক্তার হিসেবে ডিগ্রি পেলেন আনন্দীবাই যোশী। তাঁকে অভিনন্দন জানান খোদ ইংল্যান্ডের রানি ভিক্টোরিয়া।
আমেরিকার অর্থনৈতিক সুযোগসুবিধার মোহে স্বামী তাঁকে প্ররোচনা দিয়েছিলেন বিদেশেই থেকে যাওয়ার জন্য। কিন্তু এবার আর মুখ বুজে স্বামীর কথা মেনে নেননি নবীন চিকিৎসক। তিনি তো দেশের সেবা করতে চান, তাই অর্জিত জ্ঞান নিয়ে ফিরে এলেন স্বদেশেই। যোগ দিলেন কোল্হাপুরের অ্যালবার্ট এডওয়ার্ড হাসপাতালে। তবে মাত্র এক বছরের জন্য। তারপর সেই কালান্তক যক্ষ্মাই ছিনিয়ে নিল তাঁর জীবন।
সেকালের মেয়েদের যে অবদমনের মধ্যে দিয়ে যেতে হত, আনন্দীবাই যোশীর জীবন তার চেয়ে আলাদাভাবে কাটেনি। কিন্তু শিক্ষার দিকে নিজের জীবনকে বইয়ে দিয়ে, সে জীবনকে আলাদা করে তোলার চেষ্টা করেছিলেন তিনি নিজেই। পিতৃতন্ত্রের দমনের মধ্যে থেকেও জিইয়ে রাখতে চেয়েছিলেন নিজস্ব স্বর। সেই কৃতিত্বের জন্য দেশের এই প্রথম মহিলা চিকিৎসককে মনে না রেখে উপায় নেই।