জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে হওয়া ক্ষতির ঘটনা নতুন নয়। কিন্তু যেভাবে তা বিশেষভাবে মেয়েদের শারীরিক তথা সামাজিক অবক্ষয়ের পথ প্রশস্ত করছে, তা রীতিমত চিন্তাজনক। জলবায়ু পরিবর্তন যেভাবে বিশ্বের নারীদের বিপর্যস্ত করে তুলছে, তা পৃথক আলোচনাই দাবি করে।
যে কটা ছাগল, ভেড়া ছিল, জল না পেয়ে শুকিয়ে মরে গেছে। মেয়ের বিয়ে দিলে, বদলে পণ হিসেবে পাওয়া যাবে তিনটে ছাগল। উপরন্তু দু-তিনটে উট। তা দিয়ে পরের কয়েকটা সপ্তাহের খাবারের জোগান মিটে যাবে। তাই বুকে পাথর রেখেই মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন কেনিয়ার খরাক্লিষ্ট গ্রামের বাবা-মায়েরা। তাঁরা জানেন, অচেনা পুরুষটি তাঁদের আগামী ক’দিনের উদরপূর্তির বন্দোবস্ত করবার মূল্য হিসেবে মেয়েটিকে প্রায় ‘যৌনদাসী’ করে রাখবে আজীবন। তাতেও যন্ত্রণা শেষ হবে না। সন্তান জন্মালে, তাদের পালন, রক্ষণাবেক্ষণ, সমস্তটার দায় মায়ের একার। মাকে তখন পেটের দায়ে উট কিংবা খচ্চর চরাতে যেতে হবে দূরের মাটিতে। গাধার পিঠে জেরিক্যান বেঁধে হাঁটতে হবে মাইলের পর মাইল পথ, কুয়োর পাশে নিজের পালার জন্য অপেক্ষা করতে হবে কয়েক ঘণ্টা। সবশেষে হয়তো কয়েক ক্যান জল জোগাড় করতে পারবে সে, নিশ্চিন্ত হতে পারবে কেবল সেই সপ্তাহটুকুর মতো।
এ ঘটনা কেনিয়ার। খরায় জনজীবন হয়েছে বিপর্যস্ত। আর তার প্রভাব এসে পড়েছে সে-দেশের নারীদের উপর।
যে বাবা-মা সন্তানকে বেচে দিলেন এ জন্মের মতো, তারা তবে মুক্তি পেলেন কি? অসম্ভব! খরা যে শুষে নিয়ে গেছে তাঁদের চারিদিকের সমস্ত সবুজটুকু! ফলে পণে পাওয়া প্রাণীগুলোকে প্রাণে বাঁচাতে নতুন চারণভূমির সন্ধানে বহুদূর যাত্রা করতে হবে তাঁদের। তবে লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, পায়ে হেঁটে জল তুলতে যাওয়ার কাজ অথবা নতুন ঘাষজমি খুঁজতে যাওয়ার কাজ কিন্তু কখনওই পরিবারের পুরুষ সদস্যদের করতে দেখা যায় না। তারা সে সময়ে শান্তিতে শুয়ে থাকতে পারেন গাছের ছায়ায়। অন্যদিকে সদ্য পনেরো বা ষোলোয় পা দেওয়া যে কিশোরীটিকে বেছে নেওয়া হয় পশুচারণের জন্য, সে জানে, নতুন চারণক্ষেত্রে সে এবং তার মতো অন্য মেয়েদের অপেক্ষায় অধীর আগ্রহে বসে রয়েছে শিকারীর দল। পরিবারের থেকে অত দূরে কেবলমাত্র কয়েকটি ছাগল-ভেড়াকে সম্বল করে যাত্রা করবার অর্থই হল সম্ভাব্য ধর্ষকদের মুখোমুখি হওয়া। আর একবার ‘অপবিত্র’ হয়ে ফিরে এলে, সবার আগে মেয়েটির স্বামী অথবা পরিবারের অন্য পুরুষেরা মিলেই দলছাড়া করে ছাড়বে তাকে! কে ভাবতে পারে, কেবল জলকষ্ট মেয়েদের এতখানি সস্তা ও বিধ্বস্ত করে তুলতে পারে!
প্রায়শই খবরে শুনতে পাওয়া যায়, প্রথম বিশ্বের দেশগুলিতে পরিবেশ রক্ষা বিষয়ক গুরুতর সব সমাবেশ আয়োজিত হচ্ছে। তাতে জমায়েত করেন নামী পরিবেশবিদেরা। বেশ কিছুদিন ধরে সমাবেশ চলে, এ বাবদ তাগড়াই বাজেট বরাদ্দ করেন সরকার। কিন্তু শেষ অবধি ভাসা ভাসা কিছু স্লোগান আর “পরিবেশ বাঁচানোর দায়িত্ব আমাদেরই হাতে” জাতীয় বুলিতে তার সমাপন ঘটে।
কেনিয়া থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মাইল দূরের ভারতবর্ষের মহিলারাও একইভাবে শিকার হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের। সাম্প্রতিক কিছু সমীক্ষা জানাচ্ছে, শ্রমজীবী নারী তথা মহিলা গিগকর্মীদের উপর ক্রমবর্ধমান বিশ্ব উষ্মায়নের প্রভাব ভয়াবহ। গরমকালে পুরুষ নারী উভয়ের ক্ষেত্রেই হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা যেমন থাকে, তেমনই নারীদের জন্য উপরি বরাদ্দ হচ্ছে পেলভিক ইনফেকশনের মতো রোগ, যা সরাসরি তাদের যৌনজীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ফলত, গৃহহিংসা, সামাজিক বহিষ্করণ ইত্যাদি।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে হওয়া ক্ষতির ঘটনা নতুন নয়। কিন্তু যেভাবে তা বিশেষভাবে মেয়েদের শারীরিক তথা সামাজিক অবক্ষয়ের পথ প্রশস্ত করছে, তা রীতিমত চিন্তাজনক। জলবায়ু পরিবর্তন যেভাবে বিশ্বের নারীদের বিপর্যস্ত করে তুলছে, তা পৃথক আলোচনাই দাবি করে।