ঘরের শ্রম কি শুধু মেয়েদের? মেয়েলি কাজ বলে বরাবর গৃহস্থালির কাজকে কটাক্ষ পুরুষের। এবার সেই বিতর্ক উঠে এল কপিল শর্মার শো-তে। তার প্রেক্ষিতে সটান উত্তর সুধা মূর্তির। কী বললেন তিনি? শুনে নিন।
ঘরে আর বাইরে। দু’জায়গার কাজ অক্লেশে সামলান মহিলারা। কিন্তু পুরুষরা! এখনও সেই ক্লিশে ধারণা ঘাঁটি গেড়ে বসে আছে, যে, সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে। পুরুষদের মধ্যে এর ব্যতিক্রমী চিন্তার মানুষ যে নেই, তা নয়। তবে, বছরে পর বছর এই ধারণার ভিতর বাস করতে করতে এখনও পুরুষরা ঘরের কাজকে বা গৃহশ্রমকে তেমন একটা গুরুত্ব দেন না। বরং তা যেন অনেকখানি হাসাহাসির ব্যাপার। কেউ কেউ বলেন গৃহশ্রম ‘মেয়েলি’। এবার হাসতে হাসতেই সেই ধারণার দিকে কটাক্ষ ছুড়লেন প্রখ্যাত লেখিকা সুধা মূর্তি। বলা যায়, হাসির ছলেই কাজের কথাটা শুনিয়ে দিলেন তিনি।
প্রসঙ্গটা উঠল কপিল শর্মার জনপ্রিয় কমেডি শো-তে। সাম্প্রতিক এক পর্বে সেখানে অতিথি হয়ে এসেছিলেন সুধা মূর্তি, ছিলেন তাঁর স্বামী ইনফোসিসের সহ-প্রতিষ্ঠাতা নারায়ণ মূর্তি-ও। মজার ছলে বিভিন্ন কথা তাঁরা ভাগ করে নিচ্ছিলেন সঞ্চালকের সঙ্গে। আর তারই মাঝে লেখিকা মজা করে পরামর্শ দিয়েছিলেন, “প্রত্যেক পুরুষেরই উচিত গৃহস্থালির কাজকর্ম করতে শেখা।” অর্থাৎ স্ত্রীর সঙ্গে গৃহকর্মে সহায়তা করা। কপিল মজা করেই পালটা বলেন, তিনি নাকি সকাল সকাল বাসনপত্র মেজে তবেই এসেছেন। কপিল তুখড় সঞ্চালক, তাঁর সেন্স অফ হিউমারও প্রখর। কিন্তু শুধু হিউমার দিয়ে কি সুধা মূর্তিকে পরাস্ত করা যায়! তিনি তখুনি জিজ্ঞাসা করেন, ‘কই আপনার হাত দুটি দেখান তো?’ আর তাতেই কপিলের সব জারিজুরি ধরা পড়ে যায়। কপিল হাসতে হাসতে হাত দেখান বটে, তবে বলেন, ‘আমি তো হাত ধুয়ে ফেলেছি।’ এর পর সুধার উত্তর ছিল নজরকাড়া। সোজা ব্যাটে ছক্কা হাঁকিয়ে তিনি বলেন, ‘আপনি যদি থালা-বাসন ধুতেন, হাতের ছাপেই তা বোঝা যেত।’ বোঝাই যাচ্ছে, কপিল হাসির ছলে যে বিষয়টি বলতে চেয়েছেন, সেই দান পালটা ঘুরিয়ে দিয়েছেন সুধা। উপস্থিত দর্শক তখন ফেটে পড়ে হাসিতে। কারও আর বুঝতে বাকি থাকে না যে, সুধার জবাবের তির আসলে পুরুষতন্ত্রের প্রতিই। হাসতে হাসতেই তিনি কপিলের উদ্দেশে বলেন, তাঁর সঙ্গে ‘পাঙ্গা’ নেওয়া মোটেও সহজ কম্মো নয়।
নেহাতই হাসিমজার মুহূর্ত। তাও আবার এক কমেডি শোয়ের টুকরো অংশ। কিন্তু মুহূর্তটি সাফ জানিয়ে দিল, এই আধুনিক সমাজেও পুরুষতন্ত্রের পুরনো ধারণা বেঁচেবর্তে আছে বহাল তবিয়তে। পুরুষ করবে বাইরের কাজ, আর মেয়েরা করবে ঘরের কাজ, থুড়ি মেয়েদের কাজ। হ্যাঁ, মেয়েদের কাজ। আজকের দিনে দাঁড়িয়েও এই শব্দটা বহাল তবিয়তে রয়ে গেছে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে। মহাকাশ বিজ্ঞান থেকে শুরু করে রাজনীতি, চিকিৎসা থেকে বিনোদন- সব ক্ষেত্রেই মহিলারা আজ সমান ভূমিকায় ও দক্ষতায় কাজ করেন। তবু ধারণার পুরনো চাদর আজও আমরা বয়ে নিয়ে চলেছি। গৃহস্থালির দৈনন্দিন কাজগুলি,যেগুলো করতে পারা প্রতিটি মানুষেরই সাধারণ দায়িত্ব, তা নিয়েও হাজারো ব্যবধান। আর এই ব্যবধানের একটি অন্যতম কারণ হল পুরুষেরই টীকাটিপ্পনী। এ অবশ্য নতুন কথা নয়। ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যটির কথা আপনাদের নিশ্চয়ই মাথায় আছে। হর গৌরীর ঝাগড়া-ঝাঁটির জায়গাটা একবার মনে করুন- ‘নারী যার স্বতন্তরা, সেই জন জীয়ন্তে মরা, তাহার উচিত বনবাস’। তাহলেই ভাবুন, স্বাধীন স্বতন্ত্র নারীকে অঙ্গীকার করা স্বামীর অবস্থা নাকি অসহায়! স্বীকার করেই নিচ্ছেন সেই সময়ের লেখক।
সময় পেরিয়েছে অনেকটাই। কিন্তু ধারণা সেভাবে বদলেছে কি? এর উত্তর, না। এখন আর মঙ্গলকাব্য না লেখা হোক, বিশ্ব ব্যাঙ্কের সমীক্ষা কিন্তু জানিয়ে দিচ্ছে সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চাকরিক্ষেত্রে মেয়েদের নিয়োগের হার বিয়ের পর ১২ শতাংশ কমে যায়। আর একেই ‘ম্যারেজ পেনাল্টি’ অর্থাৎ ‘বৈবাহিক খেসারত’ বলে চিহ্নিত করছে বিশ্ব ব্যাঙ্ক। শুধু এখানেই শেষ নয়। যে নারীদের সন্তান রয়েছে, তাঁদের ক্ষেত্রে এর পাশাপাশি ‘চাইল্ড পেনাল্টি’-র কথাও বলা হচ্ছে, অর্থাৎ সেখানে নারীর চাকরিতে নিয়োগের হার আরও কমে যাচ্ছে। কেবল মেয়েদের জন্যই নয়, গোটা দেশের লক্ষ্মীলাভের জন্যই এই বিষয়টিতে আশু নজর দেওয়া দরকার হয়ে পড়েছে।
এই জাঁকিয়ে বসা ধারণাটিকেই যেন হাসতে হাসতে উড়িয়ে দিলেন সুধা মূর্তি। যে কথা বহু তত্ত্ব, তথ্যে বলেও ফল হয় না, তাই-ই অনেক সময় সহজ কথায় সরল করে বললে অনেকেই বুঝতে পারেন। জনপ্রিয় কমেডি শো-তে যে হাসিমজার ছলেও যে গুরুত্বপূর্ণ কথাটি বলে ফেলা যায়, সেই কথাটিই আর একবার যেন মনে করিয়ে দিলেন লেখিকা।