কোনও নারী সফল হলেই বাঁকা চোখেরা বলে, এ সাফল্যের পিছনে নিশ্চয়ই অন্য কোনও গল্প আছে। কোনও পুরুষের অফিসে বেশিক্ষণ কাটানো মানে প্রোমোশনের জন্য কাজ করা, আর কোনও মেয়ের বেশি রাত পর্যন্ত অফিসে থাকা মানেই বসের মনোরঞ্জন করা- এ সহজ সমীকরণ চলছেই। কোনও মেয়ে যে নিজের প্রতিভা কিংবা যোগ্যতার জোরে সফল হতে পারেন, সে কথা ভেবেই উঠতে পারেন না অনেকে। তাই মেয়েদের সাফল্যের কথা শুনলেই তাঁরা অন্যরকম গল্পের সন্ধানে হাতড়াতে থাকেন, আর ক্রমাগত নিজেদের মনের বিষ ছুড়ে দিতে থাকেন সেই মেয়ের দিকে।
মহিলারা সাফল্য পেলেই লোকে ঘৃণা ছড়ায়। চড় কাণ্ডের পর বলছেন কঙ্গনা রানাউত। বর্ষীয়ান অভিনেতা অন্নু কাপুরের এক মন্তব্যের প্রেক্ষিতেই এ কথা বলছেন তিনি। আসলে চড় প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে কঙ্গনাকে না চেনার ভান করেন অভিনেতা। কঙ্গনা সাংসদ হয়েছেন শুনেও তিনি বলেন, “তা হলে তো তাঁর ক্ষমতাও রয়েছে! নিরাপত্তারক্ষী চড় মেরেছে যখন, তার তদন্ত হবে।” এর পরেই সমাজমাধ্যমে পালটা জবাব দিয়ে কঙ্গনা প্রশ্ন তুলেছেন, “আমরা কি সফল মহিলাদের ঘৃণা করি? সেই মহিলা যদি শক্তিশালী হন, তা হলে আরও বেশি করে ঘৃণা করি? এর সঙ্গে যদি সেই মহিলার হাতে ক্ষমতা থাকে, তা হলে কি তাঁকে আরও বেশি করে ঘৃণা করা হয়?” অর্থাৎ, কঙ্গনা পরোক্ষে বলতে চেয়েছেন, তিনি সফল এবং তাঁর হাতে ক্ষমতা রয়েছে বলেই তিনি অনেকের চক্ষুশূল। কঙ্গনার অবস্থান বিচার করলে তাঁর মন্তব্য নিয়ে নানারকম বিতর্ক উঠতেই পারে। অভিনয়ের দুনিয়ায় নিজের দক্ষতা দিয়েই পাকাপোক্ত ঠাঁই করে নিয়েছিলেন কঙ্গনা। তবে শাসকদল বিজেপির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়তেই বিতর্কের কেন্দ্রে চলে আসেন তিনি। কখনও দেশের স্বাধীনতা নিয়ে ভুল তথ্য, কখনও কৃষকরমণীদের নিয়ে বেফাঁস মন্তব্য, নানা কারণেই সমালোচনা কুড়িয়েছেন তিনি। রাজনৈতিক মতাদর্শ না মিললেই কাউকে লাগামছাড়া আক্রমণ করা প্রায় অভ্যাস করে ফেলেছেন তিনি। স্বাভাবিকভাবেই উলটোদিক থেকেও পালটা তির হজম করতে হয়েছে তাঁকে। ফলে কেবল সফল বলেই তাঁকে আক্রমণ করা হয়েছে, কঙ্গনা এ কথা বললেও তা পুরোপুরি সত্যি নয়।
আরও শুনুন:
নারীর সম্মান তার যোনিতে রেখেছে কে! পালটা প্রশ্ন তুলেছিলেন কমলা ভাসিন
কিন্তু, যদি প্রেক্ষিত সরিয়ে রেখে কেবল তাঁর মন্তব্যটিকেই দেখি? সেখানে কি একটুও ঠিক বলেননি কঙ্গনা রানাউত?
দিন বদলায়। দল বদলায়। অথচ ‘মেয়েদের দাম’ বদলাল কই? কিছুদিন আগেই যে ভোটের হাওয়া বইছিল দেশজুড়ে, সেখানে আরও একবার দেখা গিয়েছে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নারী হলে তাঁর দিকে কী পরিমাণে ঘৃণাভাষণ ছুড়ে দিয়েছেন নেতারা। কোনও নারীর কথাবার্তা, চিন্তাভাবনা, আচার আচরণ, যে কোনও কিছুর বিরোধিতা করতে হলেই ‘যৌনকর্মী’ খোঁচা দিয়ে বসেন নেতা থেকে জনতা সকলেই। কোনও নারী সফল হলেই বাঁকা চোখেরা বলে, এ সাফল্যের পিছনে নিশ্চয়ই অন্য কোনও গল্প আছে। আবার কারও অফিস থেকে ফিরতে দেরি হলে, কিংবা দশটা-পাঁচটার চাকরি না করলেও সেই একই কানাঘুষো ছড়ায়। কোনও পুরুষের অফিসে বেশিক্ষণ কাটানো মানে প্রোমোশনের জন্য কাজ করা, আর কোনও মেয়ের বেশি রাত পর্যন্ত অফিসে থাকা মানেই বসের মনোরঞ্জন করা- এ সহজ সমীকরণ চলছেই। অনেক কর্মরতা মহিলাই যেমন আক্ষেপ করে জানান, কর্মক্ষেত্রে নিজেদের প্রমাণ করার জন্য অনেকসময়ই বেশি পরিশ্রম করতে হয় তাঁদের, নিতে হয় বেশি দায়িত্ব পালনের ভার। মেয়েদের দিয়ে কাজ হবে না, কিংবা মেয়েরা আসলে যোগ্যতা ছাড়া কোনও আনুকূল্যের মাধ্যমেই কাজ পেয়েছেন, এমন পূর্বানুমান বাসা বেঁধে আছে যে! কোনও মেয়ে যে নিজের প্রতিভা কিংবা যোগ্যতার জোরে সফল হতে পারেন, সে কথা ভেবেই উঠতে পারেন না অনেকে। তাই মেয়েদের সাফল্যের কথা শুনলেই তাঁরা অন্যরকম গল্পের সন্ধানে হাতড়াতে থাকেন, আর ক্রমাগত নিজেদের মনের বিষ ছুড়ে দিতে থাকেন সেই মেয়ের দিকে।
আরও শুনুন:
মেয়েদের দাম কত! শাসক থেকে বিরোধী, সব পথ শেষে মিলে যায় একই প্রশ্নে?
আসলে যে সমাজের নিয়ন্ত্রণ দীর্ঘদিন পুরুষের হাতেই ছিল, সেখানে মেয়েদের জন্য পরিসর বরাদ্দ হয় না সহজে। জায়গা ছেড়ে দেওয়া যে সহজ কথা নয়। তাই ইতিহাস বলে, ঘরের চার দেওয়াল থেকে বাইরে পা রাখতে, শিক্ষা ও কাজের জগতে নিজেদের ঠাঁই করে নিতে লাগাতার লড়াই করতে হয়েছে মেয়েদের। আর সেই সময় থেকেই, তাল মিলিয়ে চলেছে ঘৃণাভাষণও। নারীশিক্ষার প্রথম যুগে ছড়া বাঁধা হয়েছে, “যত ছুঁড়িগুলো তুড়ি মেরে কেতাব হাতে নিচ্ছে যবে/ তখন এ বি শিখে বিবি সেজে বিলাতি বোল কবেই কবে।” শিক্ষিত মেয়ে মানেই উচ্ছৃঙ্খল, অসভ্য, যৌনতার জন্য আকুল এক প্রজাতি, এই মর্মে সেসময় সঙের গান, প্রহসন, কী না হয়েছে! মেয়েরা কর্মজগতে পা রাখার সময়েও বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়েছে একইভাবে। এ দেশের প্রথম মহিলা চিকিৎসক কাদম্বিনী গাঙ্গুলির জীবন বলে, তাঁকে ডাক্তার হতে না দেওয়ার জন্য কী প্রবল চেষ্টা করা হয়েছিল! আবার চিকিৎসক হওয়ার পরেও, তাঁকে অচ্ছুতের মতো করে দেখেছে অনেক বাঙালি পরিবার। এখন সময় তার থেকে বদলেছে হয়তো। তবে এখনও প্রতিষ্ঠিত মেয়েদের প্রতি সে মনোভাব কিন্তু অনেকাংশেই বদলায়নি। কঙ্গনা রানাউতের বেলায় সে কথা সত্যি হোক বা না হোক, অনেক সফল মেয়েই যে এই ঘৃণার সঙ্গে নিত্য মোকাবিলা করছেন, তা অস্বীকার করা উপায় নেই।