পুরনো পর্দার কাপড় কেটে ট্রাউজার বানিয়ে নিয়েছিলেন নিজেই। প্রতিবেশীর বাতিল গাড়ির সিট কভারের রেক্সিন দিয়ে বানিয়েছিলেন ওয়াটারপ্রুফ ব্যাগ আর গ্লাভস। আর এইসব নিয়েই বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্টের দিকে পাড়ি দিয়েছিলেন জুনকো তাবেই। সহায় সম্বল কিছুই ছিল না, তবুও হার মানেননি এই গরিব মেয়েটি। আর এই অদম্য জেদেরই বুঝি প্রতিদান দিয়েছিল পাহাড়ও। বিশ্বের প্রথম মেয়ে হিসেবে এভারেস্টের চূড়ায় পা রেখেছিলেন তিনি। আসুন, শুনে নেওয়া যাক সেই আশ্চর্য উত্থানের গল্প।
পাহাড়ের নেশায় ঘর ছেড়ে বারবার ছুটে যান অভিযাত্রীরা। কারও কারও ঘরে ফেরাই হয় না আর কখনও। তবুও পাহাড়ের টান বারবার হাতছানি দেয় মানুষকে। আর সেই টানেই সব বাধার পাহাড় ডিঙোয় মানুষ। যেমনটা করেছিলেন জাপানের গরিব ঘরের মেয়ে জুনকো তাবেই। তিনিই প্রথম মেয়ে, যিনি জয় করেছেন বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট।
আরও শুনুন: পাকিস্তানের নাগরিকত্ব নিচ্ছেন ভারতীয়রা! ইঙ্গিত মিলছে তথ্যে, কারণটা কী?
কিন্তু মেয়েদের চলার পথটা তো কখনোই খুব একটা সহজ ছিল না। মেয়েরা পাহাড় চড়বে, মেয়েরা যুদ্ধে যাবে, মেয়েরা উচ্চশিক্ষা নেবে, এই সবকিছু মেনে নিতেই বারেবারে নারাজ হয়েছে গোটা পৃথিবীটা। তার উপরে আবার হতদরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা কোনও মেয়ে। যে বছর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হল, সেই বছরই জন্ম হয় জুনকোর। যুদ্ধের জেরে ভেঙে পড়া দেশে, বেহাল অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে সাত ভাইবোনকে নিয়ে সংসার চালাতে মা-বাবা এমনিতেই নাজেহাল। দিন আনা দিন খাওয়া সেই পরিবারে পাহাড় চড়া বিলাসিতা ছাড়া আর কী! পাড়াপড়শিরা মুখ বাঁকিয়ে হাসে, বলে ‘গরিবের ঘোড়ারোগ’। কিন্তু মেয়েটিও মরিয়া। ছোটবেলায় স্কুল থেকে একবার ট্রেকিংয়ে গিয়েছিল সে। পাহাড়ের প্রতি সেই যে প্রেমের জন্ম হল, দিনে দিনে আরও গভীর হয়েছে তা। রোজকার অভাব দুঃখ কষ্টে ভরা পৃথিবীটা উঁচু পাহাড়ের মাথা থেকে দেখলে কেমন পালটে যায়, তা দেখার আশ মেটে না তার। তাই টিউশন পড়ানোর টাকা জমিয়েই বারবার পাহাড়ে ছোটে মেয়ে। বন্ধুদের থেকে ধার নেওয়া সামান্য সরঞ্জামের জোরেই আরোহণ করে ফেলে দেশের একাধিক শৃঙ্গ। অথবা কখনও কপালজোরে কোনও অভিযাত্রী দলের সঙ্গে থাকার অনুমতি মেলে। বলাই বাহুল্য, সে দলে সকলেই পুরুষ। তাঁদের কাছে জুনকোর অবস্থাটা প্রায় কাজের মেয়ের মতোই। ক্যাম্পে রান্নাবান্না-সহ যাবতীয় কাজকর্ম করে দেওয়ার বিনিময়েই অভিযানে শামিল হতেন জুনকো। যদিও এর ফলে পড়শিরা তাঁর চরিত্রে কালি লাগাতে কসুর করেননি। কিন্তু তাতেও এ মেয়েকে পাহাড় থেকে দূরে রাখা যায়নি কখনোই।
আরও শুনুন: জ্ঞানের পথে বাধা নয় ধর্ম, রামায়ণ নিয়ে কুইজে সেরার খেতাব দুই মুসলিম পড়ুয়ার
তবে পাহাড়ের সূত্রেই একসময় প্রেম আসে তাঁর জীবনে। যথার্থ বন্ধুর মতোই তাঁর হাত ধরেন জাপানি পর্বতারোহী মাসানোবু তাবেই। স্ত্রীয়ের পাহাড়প্রেমকে আরও সাহস জোগালেন তিনি। যার ফলে বিয়ের দশ বছর পর, ১৯৭৫ সালের মার্চে এভারেস্ট বেস ক্যাম্পে এসে হাজির হলেন জুনকো তাবেই। তিন বছরের মেয়েকে সামলানোর দায়িত্ব নিয়েছিলেন তাঁর স্বামী ও বোনেরা। কিন্তু এভারেস্টে যাওয়ার মতো সাজসরঞ্জাম জোগাড় করা সম্ভব ছিল না গরিব জুনকোর পক্ষে। হাল না ছেড়ে পুরনো বাতিল জিনিসপত্র কেটে জুড়ে নিজের হাতেই ঠান্ডার উপযোগী পোশাক বানিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। তার আগেই ১৯৬৯ সালে ‘লেডিস ক্লাইম্বিং ক্লাব’ খুলেছিলেন জুনকো, যাতে তাঁর দেশের গরিব মেয়েদের পাহাড়ে চড়তে গিয়ে তাঁর মতো অপমানের মুখোমুখি হতে না হয়। আর এই ক্লাবের সদস্যরাই আত্মীয় বন্ধুদের থেকে ধার করে এভারেস্ট অভিযানের ফান্ড জোগাড় করতে শুরু করেছিলেন। এইভাবেই কুড়িয়েবাড়িয়ে এভারেস্ট অভিযানে পা বাড়িয়েছিলেন জুনকো-সহ ক্লাবের ১৫ সদস্য।
আর্থিক সংগতি নেই, অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি আর প্রযুক্তির সুবিধা নেই, এমনকি প্রকৃতির সমর্থনও মিলছিল না সেভাবে। একদিন তুষারধসে চাপা পড়ে প্রায় মরতেই বসেছিলেন অভিযাত্রীরা। এই ঘটনায় মনোবল ভেঙে গেল দলের। ফেরার পথ ধরলেন দলের ১৪ জন সদস্যই। কিন্তু গোড়ালিতে আঘাত নিয়ে নির্জন তুষারসমুদ্রে একা রয়ে গেলেন জুনকো তাবেই। সঙ্গে কেবল একজন শেরপা, আং শেরিং। এতদিনের অভিজ্ঞতা থেকে জুনকো জানতেন, জীবন তাঁকে আরেকবার সুযোগ দেবে না। তাই এবারেই শীর্ষে পৌঁছাতে হবে তাঁকে। মেয়ে বলে, গরিব বলে পাওয়া সব অপমানের পালটা জবাব তাঁকে দিতে হবে এভাবেই। আর সেই জবাবটাই দিয়েছিলেন জুনকো তাবেই। ১৯৭৫ সালের ১৬ মে এভারেস্টের চূড়ায় এসে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। একা। কেবল এভারেস্টই নয়, প্রথম নারী হিসেবে সেভেন সামিট অর্থাৎ সাত মহাদেশের সাতটি সর্বোচ্চ পর্বতচূড়াও জয় করেছিলেন তিনি। আর সেইসঙ্গে মেয়েদের সামনে খাড়া দাঁড়িয়ে থাকা বাধার পাহাড়টাকেও অনেকখানি চুরমার করে দিয়েছিলেন জুনকো তাবেই।