যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা সেখানকার মহিলা ও শিশুদের। রুশ বাহিনীর হাতে অকথ্য অত্যাচারের শিকার অসংখ্য যুদ্ধবন্দি। তবে রুশ সেনাকে এত বড় অন্যায়ের শাস্তি দিতে বদ্ধপরিকর ইউক্রেনের প্রশাসন। সেই সমস্ত যুদ্ধবাজদের বিচারের ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন সেখানকারই এক মহিলা। তিনি ইউক্রেনের প্রথম মহিলা প্রসিকিউটর জেনারেল। যুদ্ধবাজদের বিচারের বানী শোনাতে দিনরাত ছুটে মরছেন তিনি। মরিয়া হয়ে জোগাড় করে আনছেন প্রমাণ। আসুন শুনে নিই, তাঁর সেই লড়াইয়ের গল্প।
যুদ্ধের বিষাক্ত বাতাসে এক লহমায় পাল্টে গিয়েছে গোটা দেশটা। যুদ্ধ থামার আভাসমাত্র নেই। রুশ সেনার অত্যাচারে ইউক্রেন এখন ধ্বংসস্তূপ। একের পর এক শহরে তাণ্ডব চালিয়েছে পুতিন বাহিনী। সামনে এসেছে গণকবরের ছবি। বুচা-সহ বহু জায়গাতেই রুশ সেনার হাতে বন্দি মহিলাদের উপর চলছে অকথ্য অত্যাচার। তাঁদের মধ্যে অনেকেই অন্তঃসত্ত্বাও হয়ে পড়েছেন। শিশুদের অবস্থাটা আরও সঙ্গীন। সবটা মিলিয়ে ইউক্রেনে পরিস্থিতি ভয়াবহ।
রুশবাহিনীর এই ধ্বংসলীলা দেখে ক্ষোভে ফুঁসছে গোটা বিশ্ব। যুদ্ধবাজ রাশিয়াকে কাঠগড়ায় তুলতে চাইছে পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশ ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো। এই অবস্থায় চুপ করে বসে নেই সে দেশের প্রশাসনও। আলাপ-আলোচনা, একাধিক বার বৈঠকেও সমাধানসূত্র বেরোয়নি। একদিকে যখন রুশ সেনার ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার দেশের অসংখ্য মহিলা, অন্যদিকে বিচারের রাজদণ্ড নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন সে দেশেরই এক মহিলা। পুতিনের বাহিনীকে উচিৎ শিক্ষা তিনি দেবেনই। এমনই ধনুকভাঙা পণ করেছেন তিনি।
আরও শুনুন: ইউক্রেনে আতঙ্কের অন্য রূপ! অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ছেন রুশ সেনার হাতে বন্দি মহিলারা
আইরিয়ানা ভেনেডিকটোভা। তিনি ইউক্রেনের প্রথম মহিলা প্রসিকিউটর জেনারেল। আপাতত রুশ বাহিনীকে যথাযথ সাজা শোনানোই পাখির চোখ তাঁর। শুধু প্রশাসনিক পদে থাকার কারণেই নয়, এ লড়াই তাঁর ব্যক্তিগত। এমনটাই মনে করেন আইরিয়ানা।
এর আগে আইনের অধ্যাপক হিসেবে কাজ করতেন বছর তেঁতাল্লিশের আইরিয়ানা। শান্তশিষ্ট দেশটায় প্রসিকিউটর জেনারেল হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন আইরিয়ানা। সেটা ২০২০ সালের মার্চ মাস বোধহয়। সেসময় তাঁর দপ্তরটি ছিল দুর্নীতির অভিযোগে ঠাসা। এর আগে একাধিক প্রসিকিউটরকে বরখাস্ত করা হয়েছে দুর্নীতির অভিযোগে। অবস্থা এমনই ছিল যে যুদ্ধপরাধের মামলা তৈরি করার জন্যও কর্মী অমিল ছিল তাঁর দপ্তরে। ফলে প্রায় শূন্য থেকেই শুরু করতে হয়েছিল তাঁকে। গোটা দপ্তরটাকেই নতুন করে গড়ে নিয়েছিলেন আইরিয়ানা নিজের হাতে।
এখন তাঁর টেবিল উপচে পড়েছে রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে জমতে থাকা অভিযোগ আর মামলায়। ইতিমধ্যই যুদ্ধসংক্রান্ত অন্তত আট হাজার মামলার তদন্ত শুরু করেছে তাঁর দপ্তর। পাঁচশো জনেরও বেশি অভিযুক্তকে শনাক্ত করা হয়ে গিয়েছে। তার মধ্যে রয়েছেন রুশ মন্ত্রী থেকে শুরু করে রুশ সেনা কম্যান্ডার ও অন্যান্যরা।
আরও শুনুন: রুশ হানায় যদি মৃত্যু হয়! ভয়ে সন্তানের পিঠে নাম-ঠিকানা লিখে রাখছেন ইউক্রেনবাসী
গোটা দেশের সমস্ত বাসিন্দাদের সুবিচার দেওয়ার দায়িত্ব তাই এখন আইরিয়ানার কাঁধেই। সাধারণ পোশাক ফেলে শরীরে উঠেছে এখন বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট। দিনের অধিকাংশ সময়টাই বিরামহীন ভাবে ছুটে চলেছেন তিনি। কখনও বিভিন্ন দেশের বিদেশ সচিবদের সঙ্গে কথাবার্তা বলছেন তো, কখনও মামলার সূত্র খুঁজে বের করতে দৌড়চ্ছেন এ শহর থেকে ওই শহরে। দেশের বিভিন্ন সীমান্ত ও শরণার্থী কেন্দ্রগুলিতে গিয়ে যুদ্ধপীড়িতদের থেকে বয়ান সংগ্রহ করতে হচ্ছে আইরিয়ানাকে। ঘটনাস্থল থেকে কুড়িয়ে আনছেন একের পর এক বোমা, বুলেট, শেলের টুকরো। রুশ সেনার বিরুদ্ধে প্রমাণ একত্রিত করার লাগাতার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
এত এত যন্ত্রণার গল্প, কষ্টের কথা শুনতে শুনতে একটাই কথা বারবার ঘুরপাক খেয়েছে তাঁর মাথায়। যে ভাবেই হোক এইসব যুদ্ধপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতেই হবে। আর তার জন্য চাই কড়া প্রমাণ। ইতিমধ্যেই ১৬ জন ইউক্রেনবাসীকে নিয়ে একটি সিভিল সোসাইটি গ্রুপ গড়ে তোলা হয়েছে। যাঁরা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যুদ্ধপরাধের প্রমাণ খুঁজে আনতে সাহায্য করছেন। তাছাড়া সাধারণ মানুষের কাছেও আইরিয়ানার দরজা সব সময় খোলা। তাঁরাও বহু সময় বহু প্রমাণ এনে জড়ো করছেন আইরিয়ানার টেবিলে। সরকারের তরফে একটি ওয়েবসাইটও খুলে দেওয়া হয়েছে, এই সংক্রান্ত প্রমাণ অনলাইনে দাখিল করার জন্য।
যেভাবে রুশ সেনা নৃশংস ধ্বংসলীলা চালিয়েছে ইউক্রেন জুড়ে, তার ক্ষতিপূরণ হয় না। তবু যুদ্ধপরাধীদের কাছ থেকে তাঁদের সমস্ত সঞ্চিত অর্থ বাজেয়াপ্ত করতে চান আইরিয়ানা। আর সেগুলো বিলিয়ে দিতে চান যুদ্ধক্লান্তদের মধ্যে। ইতিমধ্যে যুদ্ধবিধ্বস্তদের জন্য বেশ কিছুটা অর্থ সংগ্রহ করতে সক্ষমও হয়েছেন তিনি। এর জন্য বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলির কাছে সহযোগিতার আবেদন জানিয়েছেন ইউক্রেনের এই প্রসিকিউটর জেনারেল।