যে রাঁধে সে চুল বাঁধে। খুব চলতি একটা প্রবাদ। প্রায়শই এ কথা গৌরবার্থে বলি বা শুনি আমরা। কিন্তু একবার তলিয়ে ভেবে দেখুন তো, শুধু রান্না বা প্রসাধন ছাড়া কি একজন নারীর আর কোনও কাজ থাকতে পারে না! এই প্রবাদের মধ্যেও কি কোথাও লুকিয়ে নেই সেই অসাম্যের হাতছানি? এমন হাজারটা চলতি কথার মধ্যেই কি আসলে প্রচ্ছন্ন ভাবে লুকিয়ে থাকে তেমনই ইঙ্গিত! তবে সে সমস্ত ভাবনা চিন্তাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়েছেন যাঁরা, লিখে ফেলেছেন নতুন ইতিহাস, তেমনই কয়েক জনের গল্প শুনব আজকে।
আত্মাতে স্ত্রী-পুরুষ ভেদাভেদ শুধুমাত্র ভ্রম। আত্মার আসলে কোনও লিঙ্গ হয় না। এমনটাই মনে করতেন স্বামী বিবেকানন্দ। পুরুষদের জন্য বাইরের কাজ, আর মহিলারা কেবল অন্তঃপুরবাসিনী হয়ে রাঁধবে, বাটবে, সন্তানপালন করবে।- এই ভাবনাটাকেই তো বদলে দিতে চায় আজকের সমাজ। একটু বেশিও নয়, একটু কমও নয়। নারী-পুরুষের মধ্যে সেই সাম্যটাই তো কাঙ্খিত।
তবে মাঝখানের সেই দেওয়ালটুকু সফল ভাবে ভেঙে ফেলতে পেরেছেন কেউ কেউ। তথাকথিত সমাজ যাকে অ্যাদ্দিন ধরে ‘পুরুষের কাজ’ বলে দেগে দিয়ে এসেছে, সে সব অনায়াসে করে ফেলেছেন তাঁরা। আজ শুনব তেমনই কয়েকজন নারীর গল্প, যাঁরা গড়েছেন নজির।
তাঁরা কেউ হাতে তুলে নিয়েছেন ব্যাট, কেউ বা শক্ত হাতে সামলেছেন যুদ্ধবিমান। কেউ বিজ্ঞানের প্রতিনিধি, তো কেউ পার করেছেন অতলান্তিক সমুদ্র। কেউ বা আবার যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়েছেন বুক চিতিয়ে।
মণিপুরের রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদাকে পুরুষের আদলে গড়ে নিতে চেয়েছিলেন তাঁর বাবা। সেই জন্য তাঁকে পোশাকে-আশাকে, ব্যবহারে করে তুলেছিলেন পুরুষোচিত। শিখিয়েছিলেন অস্ত্রবিদ্যা। পুত্রের অভাব মেটাতে তাঁকে বিসর্জন দিতে হয়েছিল আপন সত্তা। কিন্তু আজ আর ‘পুরুষের কাজ’ বলে কিছু হয় না। আর সেই কাজ করতে হলে নিজের সত্তাকে পোশাক বা ব্যবহারের তলায় চেপে রাখতেও হয় না। আর সেই পরিস্থিতিটা কিন্তু এমনি এমনি বদলায়নি। সেই বদলের প্রথম ব্যাটনটা কিন্তু হাতে তুলে নিয়েছিলেন এঁরাই।
আরও শুনুন: পাত্রীর গায়ের রং উল্লেখ থাকলে প্রকাশিত হবে না বিয়ের বিজ্ঞাপন, নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত সংবাদমাধ্যমের
আজ যাদের কথা বলব, সেই তালিকায় প্রথমেই রয়েছেন জি এস লক্ষ্মী। আইসিসি আন্তর্জাতিক ম্যাচ রেফারিদের প্যানেলে প্রথম মহিলা হিসেবে নির্বাচিত হন ৫১ বছরের লক্ষ্মী। ২০০৮-০৯ সালে মহিলাদের ঘরোয়া ক্রিকেটে রেফারির কাজ করেন তিনি। ইতিমধ্যে তিনটি ওয়ান ডে ও তিনটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচে রেফারি হিসেবে থেকেছেন তিনি। এতদিন যে কাজটাকে শুধুমাত্র ছেলেদের কাজ বলেই ধরা হত, সেই ধারাটা বদলে দিলেন লক্ষ্মী।
তালিকায় দ্বিতীয় যিনি, তিনিও খেলার জগতের মানুষ। এমনিতেই ক্রিকেট খেলায় পুরুষের প্রাধান্যই বেশি। তায় আবার আম্পায়ার। তবে সেই ধারণাই বদলে দিলেন ২৯ বছরের বৃন্দা রাঠি। ভারতের প্রথম মহিলা আম্পায়ার তিনিই। প্রথমে অবশ্য ক্রিকেটার হিসেবেই হাত পাকান বৃন্দা। পরে সেখান থেকেই বিসিসিআইয়ের দ্বিতীয় স্তরের আম্পায়ারিং পরীক্ষা পাশ করেন তিনি। সেখানে দ্বিতীয় হয়েছিলেন বৃন্দা।
এর পরে যাঁর কথা বলব, তিনি বিজ্ঞানী। না, বিজ্ঞানী হিসেবে তিনি মোটেও প্রথম নন। তবে তিনিই প্রথম ভারতীয় মহিলা, যিনি ৩৬০ বছরে প্রথমবার রয়্যাল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হন। ২০১৯ সালে বিজ্ঞানী গঙ্গাদীপ কউরকে লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটির তরফে ফেলো ঘোষণা করা হয়।
শুধু বিজ্ঞানেই নয়। সেনাবাহিনীতেও আজকাল নারীদেরই জয়জয়কার। লেফটেন্যান্ট জেনারেল পুনিতা অরোরা ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর প্রথম মহিলা, যিনি থ্রি স্টার ব়্যাঙ্ক পান। তিনি ছিলেন সেনাবাহিনীর চিকিৎসক। ভারতীয় সামরিক বাহিনীর আর্মি মেডিকেল কোরে কমিশনড হোন ১৯৬৮ সালে। মাত্র ২১ বছর বয়সী পুনিতার প্রথম পোস্টিং হয়েছিল ফাতেহনগরে। ইন্টার্নশিপ শেষে লেফটেন্যান্ট হিসেবে তিনি সামরিক হাসপাতালের চিকিৎসক নিযুক্ত হন। পেয়েছেন একাধিক সম্মান।
আরও শুনুন: কোলে শিশুকন্যা, ঠেলায় ক্রিকেট কিট… বিশ্বকাপের মাঠে নেমে নজির গড়লেন পাক মহিলা ক্রিকেট ক্যাপ্টেন
যুদ্ধের ময়দানেও বারবার জগদ্দল সরিয়েছেন নারীরা। ১৯৯৯ সালে ইন্দো-পাক কার্গিল যুদ্ধের সময় নিজের চিতা হেলিকপ্টার উড়িয়ে আহত সেনাদের উদ্ধার করে এনেছিলেন গুঞ্জন সাক্সেনা। তিনিই ভারতীয় বায়ুসেনার প্রথম মহিলা পাইলট, যিনি যুদ্ধে অংশ নেন। তাও মাত্র ২৪ বছর বয়সে। তাঁকে নিয়ে সিনেমাও তৈরি হয়েছে বলিউডে।
তার পরে বলব আরেক বায়ুসেনার অফিসারের কথা, যিনি প্রথম মাউন্ট এভারেস্ট জয় করেন। ফ্লাইট লেফট্যান্যান্ট নিবেদিতা চৌধুরী, তিনিই প্রথম মহিলা অফিসার যিনি মাউন্ট এভারেস্ট ও মাউন্ট কামেত জয় করেন।
এর আগে বায়ুসেনার কোনও মহিলা অফিসার শুধুমাত্র হেলিকপ্টার ও ট্রান্সপোর্ট এয়ারক্র্যাফ্ট চালাতে পারতেন। যুদ্ধবিমান ছিল ছেলেদের ব্যাপার। তবে সেই ব্যাপারটা বদলে দিয়েছিলেন ভাবনা কান্ত। তিনিই প্রথম বায়ুসেনার যুদ্ধবিমান চালক। তাঁর সঙ্গে সঙ্গেই ভারতীয় বায়ুসেনা পেয়েছিল অবনী চতুর্বেদী ও মোহনা সিং নামে আরও দুই যুদ্ধবিমান চালককে। এই তিনজন বিখ্যাত ছিল ‘ফেমাস ট্রায়ো অব 2016’ নামে।
সবশেষে যাঁর কথা বলব, তিনি ভারতের প্রথম মহিলা জওয়ান। এর আগে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে মহিলাদের নেওয়া হত না। আর সেই স্টিরিওটাইপ ভেঙে ফেলেছিলেন শান্তি টিগ্গা। মাত্র ৩৫ বছর বয়সে তিনি ভারতীয় সেনার সশস্ত্র জওয়ান নির্বাচিত হন। পেয়েছেন রাষ্ট্রপতির হাত থেকে পুরষ্কারও। তাঁর হাত ধরেই ভারতীয় সেনার দরজা খুলে গিয়েছিল মেয়েদের জন্য।
যে কোনও ক্ষেত্রে নারীদের এগিয়ে যাওয়ার ইতিবৃত্ত সহজ নয় কখনোই। প্রতিবন্ধকতার বাঁকে পড়ে অনেকেরই স্বপ্ন হারিয়ে যায়। কেউ কেউ পারেন সব বাধা পেরিয়ে নিজের স্বপ্নকে সার্থক করতে। তাঁরাই অনুপ্রেরণা জোগায় আগামী প্রজন্মকে। যেমন অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছেন এই নারীরা।