সিমরনের কথা নিশ্চিত আপনাদের মনে আছে। সেই সিমরন, যে কিনা শাহরুখের দিলবালে, হবে দুলহনিয়া। আর এই দিলবালে থেকে দুলহনিয়া হওয়ার যাত্রার ভিতরই রাখা আছে ভারতীয় গুড-গার্লের এক রূপান্তর। যতদিন সিমরন বাবার কথা শুনে চলছে, ততদিন কোথাও কোনও অসুবিধা নেই। এরপর আসেন একজন শাহরুখ বা রাজ। আর এই সাজানো তাসের ঘর তখন একটু একটু করে ভেঙে পড়তে থাকে।
মোটা নয়। রোগা নয়। বেশি কথা নয়। কম কথাও নয়। সাজে পারফেক্ট। কাজে নিখুঁত। দেখেশুনে মনে হবে যেন কাস্টমাইজ করে কিছু বানানো হচ্ছে। প্রতিমা। কিংবা রোবট। আদতে তা নয়। এ আসলে ভারতীয় সমাজের গুড-গার্ল নির্মাণের ফ্যাক্টরি।
তা কে কে হতে পারে গুড গার্ল? সিমরনের কথা নিশ্চিত আপনাদের মনে আছে। সেই সিমরন, যে কিনা শাহরুখের দিলবালে, হবে দুলহনিয়া। আর এই দিলবালে থেকে দুলহনিয়া হওয়ার যাত্রার ভিতরই রাখা আছে ভারতীয় গুড-গার্লের এক রূপান্তর। যতদিন সিমরন বাবার কথা শুনে চলছে, পরিবারের তথাকথিত সম্মান বজায় রাখছে, যতদিন নিজের ইচ্ছেকে দমিয়ে রেখে বাবার পছন্দের গান শুনছে, পুজোয় বসেছে, ততদিন কোথাও কোনও অসুবিধা নেই। এরপর আসেন একজন শাহরুখ বা রাজ। সে যেন খোলা হাওয়া। নিয়ম ভাঙার নিয়ম। আর এই সাজানো তাসের ঘর তখন একটু একটু করে ভেঙে পড়তে থাকে। স্বাভাবিক ভাবেই তাকে পছন্দ করেন না অমরীশ পুরী। সিমরনের বাবা। তিনি আর কেউ নন, এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজেরই প্রতিনিধি। অতএব রাজের সংঘাত বাধবে তাঁর সঙ্গেই। এ কাহিনি সকলেরই জানা। তা কি শেষমেশ পিতৃতন্ত্রকে অতিক্রম করতে পারে? সে প্রশ্ন আলাদা আলোচনার বিষয়। তবে এই গুড গার্লের ধারণা যে ভারতীয় সমাজব্যবস্থার এক দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা, তা এই জনপ্রিয় সিনেমার আদল টেনে সহজেই বুঝে নেওয়া যায়।
এ-দেশে জন্ম নেওয়া প্রতিটি মেয়েই সে কথা জানে। ছোট থেকেই অলক্ষ্য পাঠশালা যেন মেয়েদের শেখাতে থাকে নিজস্ব সংবিধান। ভালো আর খারাপ দেশের সীমান্ত মোটেও সুরক্ষিত নয়। সেই ধূসর রেখা যে কখন অতিক্রম হয়ে যায়, তার ঠিক নেই। ফলত পদে পদে ছোট ছোট নিয়মের ডোরে বেঁধে রেখে মেয়েদের বুঝিয়ে দেওয়া হয় ভালো মেয়ের আর্কিটাইপ ঠিক কী হতে পারে। এ এমন এক পুরুষতান্ত্রিক ধারণা যে, দীর্ঘ অভ্যাসে মহিলারাও তাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁদের হাত ধরেই এ ধারণার সংক্রমণ ঘটতে থাকে। ব্রায়ের স্ট্র্যাপ লোকানো থেকে পিরিয়ডসের কথা না বলা, এরকম অযুত অপ্রাসঙ্গিক জিনিস যেন পরম্পরা মেনে চলছে তো চলছেই। একদিন মেয়েরা বুঝে যান, এ আসলে এক চক্রব্যূহ। যা থেকে বেরনোর উপায় জানা নেই।
তবে সত্যি কি জানা নেই? কথায় বলে ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়। আর তাই যতখানি স্বাবলম্বন মহিলারা অর্জন করেছেন, তার উপর ভিত্তি করেই ন্যায্যতার মুখর দাবিতে এই বৃত্ত ভাঙতে উদ্যোগী হয়েছেন তাঁরা। শরীরের স্বাধীনতা, পোশাকের স্বাধীনতা, যৌনতার স্বাধীনতা ইত্যাদি আর তাই কোনও বিচ্ছিন্ন বিষয় হয়ে থাকে না। বরং সবই যেন বিনি সুতোয় বাঁধা পড়ে, দীর্ঘমেয়াদি এক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। সম্প্রতি তার বেশ কিছু নমুনা দেখা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, বিয়ের সাজে আর সেই চিরাচরিত লক্ষ্মী মেয়ের মতো টুকুটুকে সাজের ধারণা মেনে নিচ্ছেন না আধুনিক সময়ের মহিলারা। অনেক ক্ষেত্রে সেলেবরাও সেই পথ নিচ্ছেন না। তবে, তাঁদের প্রিভিলেজড অবস্থান থেকে নেওয়া উদ্যোগ আর একজন সাধারণ নারীর উদ্যোগ এক নয়। আজ যখন সোশ্যাল মিডিয়ায় বিয়েতে কারোর ছাপোষা সাজ নিয়ে কথা হয়, আলোচনা চলে, তখন বোঝা যায় ওই গুড-গার্ল সিন্ড্রোমের ফ্যাক্ট চেক করে ফেলেছেন মহিলারা। বোঝা যাচ্ছে, তা আদতে ভুয়ো ধারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। এই অর্জনের পথ অবশ্যই সহজ হয়নি। সহজ হচ্ছেও না। তবে হচ্ছে যে, তার প্রমাণ বেশ স্পষ্ট।
কিন্তু এই এত কথার সার তাহলে কোথায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে? আমাদের দেশের জটিল জনবিন্যাসে এ কথা এক্সুরে বলা যায় না যে, গোটা দেশের সব মহিলাদের ক্ষেত্রেই সামগ্রিক পরিবর্তন ঘটছে। আজও যখন জনপ্রিয় সিনেমায় নায়িকার যৌনচাহিদা একঘর লোকের সামনে প্রকাশ হয়ে পড়ে, তখন তটস্থ অবস্থার জন্ম হয়। সেক্ষেত্রে শহর থেকে দূরের কোনও মহিলাকে এখনও যে অনেকখানি খাঁচার ধারণা সঙ্গে নিয়েই পথ চলতে হয়, তা বোঝা যায়। অতএব সবটাই যে রাতারাতি বদলে গিয়েছে তা নয়। তবে, একথা ঠিক যে, সমাজ নির্ধারিত ভালো মেয়ের মাপকাঠি যে প্রকৃত অর্থে আত্মসম্মানের পরিপন্থী হয়ে উঠছে, তা অন্তত বুঝতে ও অন্যদের বোঝাতে পেরেছেন ভারতীয় মেয়েরা। নিজেকে গুরুত্ব দেওয়া সবার আগে জরুরি।
আবার সেই সিমরনের কথাতেই ফেরা যাক। শেষপর্যন্ত এই বিন্দুতেই সে পৌঁছেছিল। বুঝতে পেরেছিল, তার মনের ইচ্ছে। তার জন্য কোনটা জরুরি। যদিও শেষ অব্দি তার হাত ধরা ছিল বাবার মুঠোতেই। সেই হাত ছাড়া সিনেমার পোয়েটিক জাস্টিস! সমাজ কি পুরোপুরি সেই জায়গায় পৌঁছতে পারেছে? মেয়েদের নিজস্ব লড়াইয়ের পাশাপাশি এই ভাবনার জায়গাতেই পৌঁছনো বোধহয় সবথেকে জরুরি।