নিপাট ঘরোয়া একজন গৃহবধূ। রান্নাবাড়া করে, লোক খাইয়ে, ছেলেদের দেখাশোনা করেই জীবন কাটছিল তাঁর। কিন্তু সেই অন্দরমহলেই যখন দেশমায়ের ডাক এসে পৌঁছল, তখন এক মুহূর্তে সেই নিরাপদ জীবনকে ছুড়ে ফেলে বেরিয়ে এসেছিলেন দুকড়িবালা দেবী। দেশকে স্বাধীন করার জন্য যোগ দিয়েছিলেন বিপ্লবের কাজে। খাটতে হয়েছিল জেলও। আসুন, শুনে নিই সেই ভুলে যাওয়া নারীর কথা।
রাতেই দলবল নিয়ে বাড়ি ঘেরাও করেছিল সশস্ত্র পুলিশ। ইচ্ছে ছিল, অতর্কিতে হানা দেওয়ার। কিন্তু তারা জানত না, যে জিনিসের খোঁজে তাদের এই আক্রমণ, সেই জিনিসটিকে বুক দিয়ে আগলে নিয়ে বসে আছেন সেই বাড়ির গৃহিণী। ঘোমটা মাথায় সাধারণ ঘরোয়া সেই নারীর হাতে সজাগ পিস্তল। কোমরে গুঁজে রাখা আরও দুটি পিস্তল। যাতে মরার আগে পর্যন্ত দেশের শত্রুদের নিকেশ করা যায়। দেশের জন্য প্রাণ পর্যন্ত দেবেন, এই মর্মেই তো বিপ্লবের দীক্ষা নিয়েছেন তিনি। আর সেই লড়াইয়ের হাতিয়ার হিসেবেই সম্প্রতি তাঁর কাছে এসে পৌঁছেছে কয়েকটি বিদেশি পিস্তল ও কার্তুজ। নির্ঘুম চোখে তা পাহারা দিয়ে চলেছেন সাদামাটা পরিবারের এই গৃহবধূ, যাঁর নাম দুকড়িবালা দেবী।
সেটা ১৯১৪ সাল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছে। তাতে ব্রিটিশ সেনাকে তো লড়াই করতে হচ্ছেই, আর তাদের হয়ে লড়াই চালাতে হচ্ছে অসংখ্য ভারতীয় সেনাকেও। এইরকম সময়েই, ২৬ আগস্ট কলকাতায় পাঠানো হয় ৫০টি জার্মান মাউজার পিস্তল এবং বহু সংখ্যক কার্তুজের বাক্স। যা লুট করে নিয়েছিলেন সশস্ত্র বিপ্লবীরা। সেখান থেকে আটটি পিস্তল এবং দুটি বাক্স পৌঁছে দেওয়া হয় বীরভূম জেলার নলহাটির প্রত্যন্ত গ্রাম ঝাউপাড়ায়, দুকড়িবালা দেবীর বাড়িতে। তাঁর উপরেই দায়িত্ব বর্তায় ওই অস্ত্রগুলি লুকিয়ে রাখার। এদিকে এত বড় লুঠ পুলিশেরও রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। হন্যে হয়ে তদন্ত চালাতে চালাতে বিপ্লবীদের এক গোপন আস্তানা থেকে মেলে একটি চিঠি। যেখানে লেখা ছিল, ‘নদীর ধার ঘেঁষা গ্রাম বাঁশঝাড়ওয়ালা জঙ্গলে পূর্ণ। সেখানে মাসিমার কাছে ফুলের চারা ও বীজ রয়েছে। মাসিমা ফায়ার করতে জানেন।’ এই ফায়ার করতে জানার সূত্র ধরেই তদন্তে জোর বাড়ায় পুলিশ। আর অবশেষে, ১৯১৭ সালের ৭ জানুয়ারি রাতে দুকড়িবালা দেবীর বাড়িতে সেই অভিযান চালিয়েছিল পুলিশ।
আসলে ‘মাসিমা’ বলেই তাঁকে ডাকতেন বিপ্লবীরা। কারণ দুকড়িবালার বোনের ছেলে নিবারণ ঘটক ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। লুকিয়ে বিপ্লব সংক্রান্ত বই পড়া, বিপ্লবের সাথিদের নিয়ে এসে পরামর্শ করা, এসবের জন্য মাসির বাড়িই ছিল তাঁর নিরাপদ আশ্রয়। সব কথা জেনে দুকড়িবালা দেবী ঠিক করেন, তিনিও যোগ দেবেন এই লড়াইয়ে। কিন্তু যে সময়ে মেয়েদের জন্য ঘরের কোণটুকুই বরাদ্দ, সেই সময়ে গ্রাম্য এক ঘরের বউ এমন সাহস পেলেন কোথা থেকে? বিপ্লবের পথ মেয়েদের নয়, এ কথার উত্তর দুকড়িবালা সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘তোমরা যদি দেশের জন্য প্রাণ দিতে পারো, তোমাদের মেয়েরাও পারে’। বিপ্লবীদের কাছ থেকে সত্যিই অস্ত্রচালনার কৌশল শিখেছিলেন দুকড়িবালা। আর পুলিশি হামলার সেই রাতেও পিস্তল হাতে পাহারা দিয়ে তিনি সব অস্ত্র পাচার করে দিয়েছিলেন এক প্রতিবেশিনীর বাড়িতে। ভোররাতে যখন পুলিশি হাতে ধাক্কা পড়ছে দরজায়, তখনও তিনি অকুতোভয়। জানাচ্ছেন, বাড়িতে কোনও পুরুষ নেই, সুতরাং সকাল না হওয়া পর্যন্ত দরজা খোলা যাবে না।
সেদিন তল্লাশি চালিয়েও অবশ্য পুলিশ কিছু খুঁজে পায়নি। কিন্তু এ দেশে তো কোনও দিনই বিশ্বাসঘাতকদের অভাব ছিল না। দুকড়িবালা দেবী যখন পড়শির বাড়িতে অস্ত্র পাচার করছিলেন, সেই সময়ে প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে ওই পড়শি মহিলার কথা শুনে ফেলেন গ্রামের নায়েব। তিনিই পুলিশের কাছে সে কথা ফাঁস করে দেন। সেই বাড়িতে তল্লাশি করে অস্ত্র বের করে আনেন দুই বাঙালি ইন্সপেক্টর। গ্রেপ্তার করা হয় দুকড়িবালা দেবীকে। জিজ্ঞাসাবাদের নামে দুকড়িবালা দেবীর উপর অকথ্য অত্যাচার শুরু করে পুলিশ। মেলেনি জামিনও। স্পেশাল ট্রাইবুনাল কেসে সিউড়িতে বিচার শুরু হলে অস্ত্র আইনের ধারায় তাঁকে আড়াই বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের সাজা শোনান বিচারক। তিনিই প্রথম মহিলা বিপ্লবী, যাঁকে অস্ত্র আইনে সাজা দেওয়া হয়। দুকড়িবালাকে পাঠানো হয় প্রেসিডেন্সি জেলে। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের খবর পাওয়ার জন্য সেখানেও চলতে থাকে অত্যাচার। তবে শত অত্যাচারেও তাঁর মুখ থেকে একটিও সূত্র পায়নি পুলিশ।
দেশকে মুক্তি দেওয়ার লক্ষ্যে সেদিন সব বাধা ভেঙে বেরিয়ে এসেছিলেন নারীরাও। কোনও প্রাপ্তির আশা না রেখেই জীবন পণ করেছিলেন তাঁরা। আর সেই লড়াইতেই শামিল হয়েছিলেন দুকড়িবালা দেবী।