ঘরে বাইরে অনেক মেয়েকেই নানা সময়ে নানা ধরনের হেনস্তার মুখোমুখি হতে হয়। কিন্তু নিজেদের ক্ষোভ-রাগ-দুঃখের কথা কি সবাই বলতে পারেন? সবার তো বলার মতো জায়গাও থাকে না। এই শূন্যস্থানটাই অনেকখানি ভরাট করতে পারছে সোশাল মিডিয়া। কীভাবে? সে কথাই শোনাচ্ছেন চৈতালী বক্সি।
বুক ফাটে তবু মুখ ফোটে না- এই সেদিনও মেয়েদের জন্য এটাই যেন ছিল ভবিতব্য। পদে পদে বাঁধা পড়তে হত ছোট ছোট নিষেধের ডোরে। বলার মতো হাজার কথা থাকলেও, হাজার প্রতিবাদ মনে জমা হয়ে উঠলেও- তা প্রকাশের উপায় কই! রাগ, ঘেন্না, অশান্তি মনে জমে পাথর হত। আর তা নিয়েই মেয়েদের কাটিয়ে দিতে হত একটা গোটা জীবন। আর কেউ যদি এই নিয়ম কেটে বেরোনোর চেষ্টা করত, তবে নানা অপবাদ ধেয়ে আসত তার দিকে। মুখরা, ঝগড়ুটে, কুলটা থেকে ডাইনি- কী না কী বলা হয়েছে এককালে! কিন্তু দিন ক্রমে বদলেছে। সোশাল মিডিয়ার দৌলতে মেয়েরা এখন আর অবোলা নয়। বরং নিজের দাবি-দাওয়ায় সে মুখর হয়ে উঠতে পারে নিমেষেই।
বাড়ি, অফিস থেকে বাস, ট্রেন- কোথাও না কোথাও যৌন হেনস্তার শিকার হয়নি এমন মেয়ের দেখা মেলা ভার। কষ্ট গলার কাছে দলা পাকিয়ে এলেও বলার উপায় তো ছিল না। লোকলজ্জা থেকে সামাজিক অবস্থান হারানোর ভয় মুখে কুলুপ আঁটতে বাধ্য করত মেয়েদের। কিন্তু সেই পরিস্থিতি বদলে দিয়েছে মেয়েরাই। ২০১৭ সালে উত্তর আমেরিকায় যে ‘মি টু’ ক্যাম্পেন শুরু হয়, তা ভাষা জুগিয়েছে অসংখ্য মেয়ের মুখে। সোচ্চারে অনেকেই বলেছেন নিজেদের হেনস্তা, হয়রানির কথা। একে অন্যের পাশে দাঁড়িয়ে বলেছেন, তুমি একা নও, আমিও আছি। এই পাশে পাশে থাকাটাও অনেকটা সাহস দিয়েছে গোটা বিশ্বের মেয়েদের। আর, শৌখিন কাজকর্মের বাইরে, এভাবেই একটা প্রতিবাদের মঞ্চ হয়ে উঠেছে সোশাল মিডিয়া।
আরও শুনুন : পাড়ার রক থেকে Social Media: রুখে দিন Body Shaming-এর দাপট
এখন মেয়েরা সোশাল মিডিয়াকে তাই কেবল শখের জিনিস বলে ভাবেন না আর। বরং তাকে বহুদিনের জমে থাকা ক্ষোভ, রাগ, ব্যথা, অভিমান জানান দেওয়ার জায়গা করে তুলেছেন তাঁরা। গায়ের রং নিয়ে কতজন না কত খোঁটা শুনেছেন। ভারী চেহারা নিয়েও কথা শুনতে হয়েছে অহরহ। পুরুষের মেপে দেওয়া সৌন্দর্যের মাপকাঠিতে উতরোতে না পেরে কত মেয়ে অবসাদের শিকার হয়েছেন। কিন্তু আজ তাঁরা অনেকেই সমস্বরে বলে উঠতে পারছেন, আমি যেমন, আমি তেমনই। কারো ইচ্ছেখুশির নিক্তিমাপা জীবন কাটাতে আর রাজি নন তাঁরা। সোশাল মিডিয়াই এখানে হয়ে উঠেছে তাঁদের মত প্রকাশের হাতিয়ার। ফলে, অনেক নিষেধের গণ্ডিই পেরোনো এখন তুলনায় সহজ।
মেয়েদের চেষ্টাতেই বিভিন্ন সময়ে সোশাল মিডিয়া ছেয়ে গিয়েছে নানারকম ক্যাম্পেনে। ‘দিস গার্ল ক্যান’, ‘লাইক আ গার্ল’, ‘মাই লাইফ মাই চয়েস’ প্রভৃতি ক্যাম্পেনগুলি বিশ্বের যে জায়গা থেকেই তৈরি হোক না কেন, তাদের উদ্দেশ্য একটাই। মেয়ে বলেই তার সামনে নানারকম বিধিনিষেধের বেড়া তুলে দেওয়া বা তাকে অন্যের ঠিক করে দেওয়া পথে চালানোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা। আর তাই খেলার পৃথিবী বা সিনেদুনিয়া থেকে উঠে আসা কোনও আওয়াজও হয়ে উঠেছে, সমাজের বহু মেয়ের মনের কথা।
বিভিন্ন সময় বিজ্ঞাপন সংস্থাগুলিও নারীকেন্দ্রিক এই ক্যাম্পেনগুলিকে গুরুত্ব দিয়েছে। বলা যায়, মেয়েরা যে আজ নিজেদের কথা সাহস করে বলতে পারছে, তার জেরেই এদের বদলে ফেলতে হয়েছে বিপণনের কৌশল। একটি জনপ্রিয় কসমেটিক্সের নাম থেকে ‘ফেয়ার’ শব্দটি যেভাবে অবলীলায় সরে গেল, তাতেই বোঝা যায় মেয়েদের কথা বলে উঠতে পারার গুরুত্ব কতখানি।
আরও শুনুন : Home + Work From Home – সব সামলে কেমন আছেন কর্মরতা মহিলারা?
অবশ্য প্রশ্ন থেকেই যায় যে, এই বিশ্বের কজন মেয়েই বা সোশাল মিডিয়া ব্যবহার করতে পারে! আর কজনই বা তাদের কথাটি বলে ফেলতে পারে? কিংবা সামিল হতে পারে আন্দোলনে? প্রশ্নগুলি ভুল নয়। আজও হয়তো বেশিরভাগ মেয়েই তা পেরে ওঠে না। আবার পারছেও তো অনেকে। সোশাল মিডিয়াকে হাতিয়ার করে, বহুকালের লক্ষ্মণরেখা একটু একটু করেও যদি পেরোনো যায়, তাই-ই বা কম কী!