‘তুমি তো কোনও কাজই করো না!’ অধিকাংশ গৃহবধূকেই কখনও না কখনও এই কথা শুনতে হয়। শুনতে হয় পয়সা রোজগার না করার খোঁটা। তাহলে সারাদিন ঘরের কাজকর্ম সামলাতে গিয়ে তাঁরা যে শ্রম দান করেন, তার কি কোনও মূল্যই নেই? সম্প্রতি সে বিষয়েই অভিমত স্পষ্ট করল এক আদালত। কী জানা গেল আদালতের ওই বিশেষ রায়ে? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
গৃহশ্রমে মজুরি হয় না বলে আন্দোলনে মেয়েদের ভূমিকাও চোখেই পড়ে না কারও। এই অভিযোগ তুলেছিলেন কবি মল্লিকা সেনগুপ্ত। বস্তুত, গার্হস্থ্য শ্রমে উপযুক্ত পারিশ্রমিক থাকবে কি থাকবে না, এই প্রশ্ন উঠছে দীর্ঘদিন ধরেই। আসলে যখন থেকে পিতৃতান্ত্রিক সমাজের সূচনা, তখন থেকেই পুরুষ আর নারীর মধ্যে কাজের বিভাজনটা খুব স্পষ্টভাবে বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। আদিম যুগে শিকারের মতো তথাকথিত পুরুষালি কাজেও রীতিমতো অংশগ্রহণ করত মেয়েরা। কিন্তু পরবর্তী যুগে বাইরের জগতে যা কিছু দৈহিক পরিশ্রমের কাজ, তা পড়ল পুরুষদের ভাগে। আর অন্দরের যাবতীয় কাজকর্মের দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া হল মেয়েদের উপরে। একইসঙ্গে বাইরের জগতের প্রকাশ্য কাজকর্মকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে দাগিয়ে দেওয়ারও শুরু। অন্দরের কাজ কারও বিশেষ চোখে পড়ারই কথা নয়। সুতরাং সে কাজে কতটা পরিশ্রম দরকার হচ্ছে কিংবা তা কতখানি জরুরি, তাও আলোচনায় আসার কথা নয়। সব মিলিয়ে ক্রমশ গৃহশ্রমের মর্যাদা শূন্যে গিয়ে ঠেকল। আর সেই পরম্পরাই বয়ে চলেছে আধুনিক পৃথিবীও। এই যুগে সবকিছুই শাসন করে পুঁজি। বাইরের কাজকর্মে পারিশ্রমিক জোটে টাকার বিনিময়ে। সুতরাং সেই কাজকে যে ঘরের কাজের তুলনায় অনেক এগিয়ে রাখা হবে, এ তো বলাই বাহুল্য।
আরও শুনুন: এককালে করেছেন বাসন মাজার কাজও, সেই দুলারী দেবীর সৃষ্টিতেই এখন গর্বিত দেশবাসী
কিন্তু আদতে কি বিষয়টা এমনই সরল? কোনও গৃহবধূ সারাদিন বাড়ির বিভিন্ন কাজে শ্রম দান করেন। উপরন্তু অফিস কাছারির মতো কোনও ছুটি, নির্দিষ্ট বেতন, অন্যান্য সুযোগসুবিধা, কিছুই পান না তিনি। এতগুলো ‘নেই’-এর পাশাপাশি আরও বড় সমস্যা হল, দীর্ঘদিন ধরে গৃহশ্রমকে এমনই লঘু করে দেখানো হয়েছে যে এই কাজের জন্য প্রাপ্য স্বীকৃতিও জোটে না তাঁর। যা ঘরোয়া বিবাদ-বিসংবাদের ক্ষেত্রে মেয়েদের বিপক্ষের একটা বড় যুক্তি হয়ে দাঁড়ায়।
আরও শুনুন: বটতলার বই থেকে আধুনিক পত্রিকার বিজ্ঞাপন… নারীশরীর কি বরাবরই ‘জনপ্রিয় পণ্য’!
এই নিয়মেরই সম্প্রতি ব্যতিক্রম ঘটাল কেনিয়ার একটি আদালত। ১৩ বছর বিবাহিত জীবন কাটানোর পর মেরি ওয়াম্বুই নামে এক মহিলার বিবাহবিচ্ছেদ মামলা উঠেছিল ওই আদালতে। তার রফা করতে গিয়ে স্বামীর বাড়ির অর্ধেক অংশ ওই মহিলার জন্য বরাদ্দ করেন বিচারক। আসলে, এই রায়েই প্রথমবার প্রয়োগ করা হল ২০১৩ সালের ম্যাট্রিমনিয়াল প্রপার্টি অ্যাক্ট। যে আইনে স্পষ্ট ঘোষণা করা হয়েছিল, আর্থিক এবং আর্থিক নয়, সংসারের ক্ষেত্রে এমন দুই ধরনের অবদানকেই স্বীকৃতি দেওয়া হবে। অর্থনৈতিক নয় এমন অবদানের মধ্যে পড়বে গৃহশ্রম, বাড়ির কাজকর্ম সামলানো, সন্তানের দেখভাল করা, এমনকি সঙ্গীকে সময় দেওয়াও। বিবাহবিচ্ছেদ ঘটলে অনেক গৃহবধূকেই যে আর্থিক সংকটের মুখোমুখি হতে হয়, তার মোকাবিলা করতে সক্ষম এই জরুরি আইনটি। আর সেই কারণেই এই রায়কে যুগান্তকারী বলে মনে করছেন নারী ও মানবাধিকার আন্দোলনের কর্মীরা।