সুরকারদের দুনিয়ায় মেয়েদের বিচরণ বরাবরই বড় সীমিত। তবে সেই পুরুষকেন্দ্রীক ভুবনে তিরিশের দশকে স্বমহিমায় হাজির হয়েছিলেন দুই সঙ্গীতশিল্পী। ভেঙেছিলেন স্টিরিওটাইপ। ভারতীয় সিনেমা পেয়েছিল তার প্রথম মহিলা সঙ্গীত পরিচালককে। বলিউডের ছবিতে জুটি বেঁধে সুর দিয়েছিলেন সরস্বতী দেবী ও জদ্দানবাই। সেই শুরু। আসুন, শুনে নিই, কেমন ছিল সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে তাঁদের পথচলা।
সিনেমা মানে তো শুধু গল্প বা কয়েকটা চরিত্রের ওঠাপড়া নয়। সিনেমাকে সিনেমা করে তোলে আরও অনেক কিছু। যার অন্যতম হচ্ছে সঙ্গীত। সেই সঙ্গীত মানে কিন্তু শুধুই গান নয়। সিনেমার একটা বড় অংশ দখল করে থাকে তার নেপথ্যসঙ্গীতও। যা ছাড়া সিনেমা বোধহয় একেবারেই নুন ছাড়া তরকারি। এসডি বর্মন, আর ডি বর্মন, সলিল চৌধুরী থেকে শুরু করে এ আর রহমান- বলিউডে প্রখ্যাত সঙ্গীত পরিচালকের তালিকাটা কিন্তু দীর্ঘ। দারুণ হিট সব গানের নেপথ্যে রয়েছেন বহু সঙ্গীত-পরিচালক জুটিও। কল্যাণজি-আনন্দজি বলুন কিংবা হাল আমলের বিশাল-শেখর। কিন্তু ভেবে বলুন তো, এঁদের মধ্যে খুব বিখ্যাত কোনও মহিলা সঙ্গীত পরিচালকের নাম মনে পড়ছে কি? বিক্ষিপ্ত ভাবে কয়েকজনের নাম মনে করা গেলেও সেই সংখ্যাটা কিন্তু সত্যিই হাতে গোনা। তবে সঙ্গীত পরিচালনার জগতে অনেক দিন আগেই কিন্তু স্টিরিওটাইপ ভেঙে ছিলেন মহিলারা। তবে সেই ধারা কেন পরবর্তীকালে একই ভাবে বজায় রইল না, তা অন্য প্রশ্ন।
ভারতীয় সিনেমার প্রথম মহিলা সঙ্গীত পরিচালক যাঁরা, তাঁদের দুজনেরই ছিল তুখোর সঙ্গীতশিক্ষা। সেটা তিরিশের দশক। সিনেমার জগতের মেয়েদের তখন তেমন মানসম্মান দেয় না সমাজ। তবু শিল্পের টানে এসে পড়েছিলেন জগৎটায়। একজনের জন্ম বিখ্যাত এক নর্তকীর গর্ভে। অন্যজন রক্ষণশীল পার্সি পরিবারের সন্তান। একেবারে ছোট বয়স থেকে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিক্ষা পেয়েছিলেন দুজনেই। তবে এমনই দুজন মানুষকে এক সুতোয় বেঁধে দিল ১৯৩৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘জওয়ানি কি হাওয়া’ নামে একটি ছবি। সেই ছবিরই সঙ্গীত নির্দেশনার ভার বর্তাল এই দুই শিল্পীর উপরে। ভারতীয় সিনেমা পেল তার প্রথম মহিলা সঙ্গীত পরিচালকযুগলকে। তখন সিনেমার জগতে সঙ্গীত পরিচালক জুটি ব্যাপারটার এমন রমরমা ছিল না। তবে এই ছবিতে জুটি বেঁধেই সুর দিলেন জদ্দানবাই ও সরস্বতী দেবী।
আরও শুনুন: প্রথম প্রযোজনা সংস্থা শুরু থেকে প্রথম সিনেমা পরিচালনা! স্পর্ধার অন্য নাম ফতিমা বেগম
জদ্দানবাইয়ের মা দলীপাবাই ছিলেন ইলাহাবাদের বিখ্যাত নর্তকীদের অন্যতম। ফলে গান ও নাচ, দুই ছিল জদ্দানের রক্তে। পরবর্তীকালে বড় বড় ওস্তাদের কাছে তালিমও নেন তিনি। কলোম্বিয়া গ্রামাফোন কোম্পানিতে গজল রেকর্ড করার পরে আরও পরিচিতি পান জদ্দান। দেশের বিভিন্ন কোণা থেকে অনুষ্ঠানের ডাক পেতেন। ততদিনে বেতারেরও চেনা নাম জদ্দান। ১৯৩৩ সালে লাহোরের প্লে আর্ট ফোটো কোম্পানি থেকে ডাক পেলেন অভিনয়ের। ‘রাজা গোপীচাঁদ’ নামে একটি ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমেই বলিউডে পা রাখলেন জদ্দান।
এদিকে, সরস্বতী দেবী ছিলেন সেদিক থেকে একেবারেই আলাদা। জন্মের পর বাবা-মা নাম রেখেছিলেন খুরশিদ। ছোট থেকেই শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে হাতেখড়ি। পরবর্তীকালে পড়াশোনাও করেছেন ধ্রুপদী সঙ্গীতের উপরেই। রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ের সিনেমাজগতে পা দেওয়াটা মোটেও সহজ ছিল না। তাই বিতর্ক এড়াতে নিজের নাম বদলে রাখলেন সরস্বতী দেবী। একবার একটি ঘরোয়া অনুষ্ঠানে তাঁর গান শুনে মুগ্ধ হল বম্বে টকিজের কর্ণধার হিমাংশু রাই। তাঁর হাত ধরেই সঙ্গীত পরিচালনার জগতে পা রাখলেন সরস্বতী। তার পর জদ্দানের সঙ্গে জুটি বেঁধে ছবিতে সুরনির্দেশনা। ব্যাস, আর ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। বলিউডের একের পর এক ছবিতে সুর দিয়ে গিয়েছেন সরস্বতী দেবী। তাঁর সুরের মেধা, প্রজ্ঞা অচিরেই তাঁকে এনে দিয়েছিল খ্যাতি।
আরও শুনুন: ক্যামেরায় চোখ রাখলেই ম্যাজিক! সিনেমাটোগ্রাফির দুনিয়ায় বদল এনেছিলেন বিজয়লক্ষ্মী
তবে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে সরস্বতী দেবীর কাজটা আজকের সুরকারদের মতো সহজ ছিল না। কারণ তাঁর সুর করা গান সে সময় যাঁরা গাইতেন, তাঁরা কেউই পেশাদার গায়ক-গায়িকা ছিলেন না। ফলে রীতিমতো শিখিয়ে পড়িয়ে নিতে হত সরস্বতী দেবীকেই। অশোক কুমার, দেবীকা রানি বা লীলা চুটনিসের মতো অভিনেতারাই ছিলেন তাঁর গায়ক। কিন্তু তাঁদের দিয়েই একের পর এক দুর্দান্ত হিট সব গান গাইয়ে নিতে পেরেছিলেন সরস্বতী দেবী। মজার কথা জানেন, ‘পড়োসন’ ছবির বিখ্যাত ‘চতুর নর’ গানটির জন্ম কিন্তু আসলে সরস্বতী দেবীর হাতেই। ১৯৪১ সালে ‘ঝুলা’ ছবিতে অশোক কুমারের গলায় ছিল সেই গানটি। পরে মান্না দে ও কিশোর কুমারের কন্ঠে সেই গানটি ফের ব্যবহার করা হয়েছিল ‘পড়োসন’ সিনেমায়।
বম্বে টকিজ ছাড়ার পরে পঞ্চাশের দশকের গোড়ায় ফের খ্যাতির আলোয় আসেন সরস্বতী দেবী। হাবিব আলি মহম্মদের সঙ্গে তাঁর গাওয়া গজল দুটি খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। রেডিয়োতে বোনের সঙ্গে মিলে অনুষ্ঠানও করতেন সরস্বতী দেবী। সেখানে তাঁদের পরিচয় ছিল ‘হোমজি সিস্টার’। তবে এত কিছুর পরেও শেষ জীবনে তাঁকে সামান্য স্বীকৃতিটুকুও দেয়নি বলিউড। বাস থেকে পড়ে কোমরের হাড় ভেঙে দীর্ঘদিন ভর্তি ছিলেন হাসপাতালে। ১৯৮০ সালে মারা যান বলিউডের প্রথম মহিলা সঙ্গীত পরিচালক। সকলের অগোচরেই ‘নেই’ হয়ে গিয়েছেন এই সঙ্গীত প্রতিভা। তবে জদ্দানবাইয়ের গল্পটা তেমন ছিল না। অভিনয় করতে করতেই নিজের প্রযোজনা সংস্থা খোলেন জদ্দান। তাঁর হাত ধরেই খুব কম বয়সে সিনেমার জগতে হাতেখড়ি হয়েছিল মেয়ে নার্গিসের। পরে ছবি পরিচালনার কাজেও হাত পাকান জদ্দান।
তবে ভারতীয় সিনেমায় সুরনির্মাতা হিসেবে মেয়েদের জন্য সেদিন একটা দরজা খুলে দিয়েছিলেন সরস্বতীদেবী ও জদ্দানবাই। আর সেই পথ ধরেই আজকে সুর বাধার স্বপ্ন দেখছেন জসলিন রয়্যাল, রচিতা অরোরা বা স্নেহা খানউইলকরের মতো একগুচ্ছ প্রতিভা।