একসময়ে অত্যাচার সহ্য করাই ছিল রোজকার রুটিন। এমনকি আত্মহত্যা করার কথা পর্যন্ত ভেবেছিলেন। আর এখন? অত্যাচারীদের শায়েস্তা করার ভারটা নিজের হাতেই তুলে নিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি নিজের মতো অন্যান্য অত্যাচারিতা মেয়েদের পাশে দাঁড়ানোর পথও গড়েছেন এই মহিলা। ফুরিয়ে যাননি, বরং জীবনটাকে সাজিয়েছেন নতুন করে। আসুন, শুনে নেওয়া যাক এই আশ্চর্য উত্তরণের গল্প।
ভারতে পনেরো-ঊর্ধ্ব মেয়েদের মধ্যে ৩০ শতাংশই কখনও না কখনও গৃহহিংসার শিকার হয়েছেন। এমনকি অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের মধ্যে গর্ভাবস্থায় স্বামীর অত্যাচারের মুখোমুখি হয়েছেন অন্তত ৪ শতাংশ মহিলা। এমনটাই জানায় সমীক্ষা। সেই নির্যাতিতা মহিলাদের শ্রেণিতেই আরেকটা নাম নৌজিশা। কিন্তু সেই শ্রেণির একজন হয়েই জীবনটা ফুরিয়ে ফেলতে চাননি তিনি। যে জীবন তাঁকে একসময় আত্মহত্যার দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছিল, সেখান থেকে লড়াই করে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন তিনি। বর্তমানে যোগ দিয়েছেন কেরলের পুলিশবাহিনীতে। আর এভাবেই আজ নিপীড়িতা মেয়েদের কাছে উদাহরণ হয়ে উঠেছেন কেরলের এই মহিলা।
আরও শুনুন: ২০২২-এও বদলায়নি অবস্থা, প্রায় সব ক্ষেত্রেই হাত বাঁধা মেয়েদের, বলছে মানবাধিকার কমিশন
গোড়ার গল্পটা অবশ্য অন্যরকম ছিল। কেরলের কোঝিকোড় এলাকার পেরাম্ব্রা গ্রামের মেয়ে নৌজিশা। কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশন নিয়ে পড়াশোনা করে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। একটি বেসরকারি কলেজে অতিথি অধ্যাপিকা হিসেবে কাজেও যোগ দেন। কিন্তু জীবনটা বদলে যায় তারপরে। ২০১৩ সালে আর পাঁচজনের মতোই বিয়ে হয় তাঁর। বিয়ের আগে শিক্ষকতা চালিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি পেলেও, নতুন সংসারে যাওয়ার পরেই তাঁকে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করা হয়। এদিকে স্বামীর বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের কথাও জানাজানি হতে বেশি সময় লাগেনি। আর তা নিয়ে প্রশ্ন করার ‘অপরাধে’ মানসিক এবং শারীরিক নির্যাতন করা হতে থাকে নৌজিশাকে।
সমস্যা হল, শ্বশুরবাড়িতে এহেন অত্যাচার সহ্য করতে হলেও অনেক মেয়েই নিজের বাড়িতে ফিরতে পারেন না। লোকে কী বলবে, এ কথা ভেবে, স্রেফ সম্মান বাঁচানোর তাগিদেই ঘরের ভেতরে অত্যাচার গিলে নেন রোজ। নারীনির্যাতন বিষয়ক সমীক্ষাগুলি দেখলে এ কথাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নৌজিশার ক্ষেত্রেও ঘটনা গড়ায় একইভাবে। তাঁর পরিবার তাঁকে বাড়িতে ফেরাতে চাইলেও, তিনি ফেরেননি। এদিকে ততদিনে তিনি একটি সন্তানের মা হয়ে গিয়েছেন। ভবিষ্যতে হয়তো অবস্থা পালটাবে, এই আশায় মার খেতে খেতেও স্বামীর বাড়িতেই পড়ে ছিলেন তিনি। কিন্তু আদতে পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়ে ওঠে যে, বাধ্যত আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন নৌজিশা। তবে সৌভাগ্যবশত শেষ মুহূর্তে তা থেকে সরে দাঁড়ান তিনি। বদলে এক বছর বয়সি ছেলের হাত ধরে স্বামীর বাড়ি ছাড়েন। আবেদন করেন বিবাহবিচ্ছেদের জন্যও।
আরও শুনুন: প্রাণে বাঁচিয়েছিলেন খোদ মার্কিন রাষ্ট্রপতিকে, প্রথম পেশাদার গোয়েন্দা এই মহিলাই
কিন্তু এই অবস্থায় দাঁড়িয়েও ফের লড়াই করেছিলেন নৌজিশা। যে চূড়ান্ত হতাশা, অবসাদ তাঁকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিয়েছিল, তার সঙ্গে লড়াই করতে হচ্ছিল তাঁকে। জীবনে ফিরে আসার প্রথম ধাপ হিসেবে তাই নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা শুরু করেন নৌজিশা। কলেজের চাকরিতে যোগ দেন আবার। পাশাপাশি প্রস্তুতি নিতে থাকেন বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্যে। অবশেষে পরিশ্রমের ফল মেলে। ২০২১ সালে সিভিল পুলিশ অফিসার হিসেবে কেরল পুলিশে যোগ দেন নৌজিশা।
যেসব নিপীড়িতা মেয়েরা বাঁচার মানে খুঁজে পান না আর, তাঁদের সামনে উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন কেরলের এই মহিলা। নির্যাতন সহ্য করে নয়, বরং তার পালটা জীবনকে কীভাবে গড়ে নেওয়া যায়, সে কথাই বুঝিয়ে দিয়েছেন নৌজিশা।