দলে দলে আসছে ট্যুরিস্টরা, এসেই সরাসরি ছুঁয়ে দিচ্ছে ব্রোঞ্জ নারী মূর্তিটির স্তন। উদ্দেশ্য, সৌভাগ্য লাভ করা। সত্যিই কি এর কোনও বাস্তব ভিত্তি রয়েছে? কোনও উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই কি এমন অশালীন আচরণ যুক্তিপূর্ণ হয়?
ডাবলিন শহরের সিটি কাউন্সিল মোতায়েন করতে চলেছে একদল নিরাপত্তা রক্ষীকে। আগত ট্যুরিস্ট-দের ‘ব্যাড টাচ’ থেকে এক নারীকে রক্ষা করতেই এহেন বন্দোবস্ত। নিযুক্ত রক্ষীরা সারাদিন পাহারা দেবেন সেই নারীকে, যাতে যে কেউ ইচ্ছেমতন তাঁর সামান্য দৃশ্যমান বক্ষযুগলকে ছুঁয়ে দিতে না পারে। তবে আশ্চর্যের বিষয় হল এই যে, উক্ত নারী কোনও মানবী নয়। বরং ব্রোঞ্জের তৈরি এক স্ট্যাচু, যা ডাবলিন শহরের মাটিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিগত ১৯৮৮ সাল থেকে।
স্ট্যাচুটি যার, সেই মলি ম্যালোন আদতে কে, তা নিয়েও দিব্যি এক রহস্য গল্প লেখা যায়। আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনের বাসিন্দা মলি ছিলেন এক যৌবন সমৃদ্ধা সুশ্রী কিশোরী, যাঁর পেশা ছিল মাছ বিক্রি করা। আচমকাই এক অচেনা জ্বরে তাঁর মৃত্যু ঘটে। কথিত আছে, এরপর তিনি প্রেতজন্ম লাভ করেন। এবং আজ অবধি ডাবলিনের পথে পথেই ঘুরে বেড়ান। সময়ের সঙ্গে আইরিশ লোককথার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জুড়ে গিয়েছে তাঁর চরিত্রটি। যেন সমগ্র ডাবলিনের প্রতীকী ইঙ্গিত বহন করেন তিনি। পরবর্তীকালে তাঁকে নিয়ে রচিত হয়েছে গান ‘সুইট মলি ম্যালোন’ ও ‘ককোলস্ অ্যান্ড মাসেলস্’, যা তাঁর জনপ্রিয়তাকে পৌঁছে দিয়েছে বহু শিল্পী গায়ক পারফর্মারের হৃদয়ের কাছে। অবশেষে নব্বইয়ের দশকের শুরুতে শিল্পী জাঁ রাইনহার্ট-এর হাতে শরীরী রূপ পেলেন মলি, সেন্ট্রাল ডাবলিনের গ্রাফটন স্ট্রিটে সগৌরবে স্থাপিত হল তাঁর মূর্তি। মূর্তির মলি সামান্য ঝুঁকে হাতল ধরে থাকেন তাঁর মাছভর্তি ঠেলাগাড়িখানার। পরনে সুদৃশ্য ফ্রিল দেওয়া জামা, যাতে জোর জবরদস্তি ভদ্রতা রক্ষার ভনিতাটুকু অনুপস্থিত। এক যুগের সাধারণ ভূতুড়ে গল্পটি অন্য যুগে পেয়েছে সামাজিক বৈষম্যের আঙ্গিক। কীভাবে এক নিম্নবিত্ত মৎসজীবী নারী হয়ে উঠল বিত্তবানদের শহরের মূল আকর্ষণ, তারই নজির হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকেন মলি ম্যালোন। প্রতি বছর অগণিত দর্শনার্থীর ভিড় জমে তাঁকে ঘিরে।
ঘটনার মোড় ঘুরল ২০১২ সালে, যখন এক ট্যুর গাইড নেহাৎ ইয়ার্কির ছলেই বলে বসেন যে মূর্তির বুকের অংশটি হাত দিয়ে ছুঁতে পারলে নাকি সৌভাগ্য নেমে আসে সে ব্যক্তির উপর। অন্য যেকোনও অশ্লীল গল্পের মতোই এ গল্পও ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগেনি। আর তা থেকেই হয়েছে বিপত্তি। দলে দলে ভ্রমণকারীরা এখন গ্রাফটনে আসছেন কেবল মলি ম্যালোনের বক্ষযুগল ছোঁয়ার উদ্দেশ্য নিয়েই। সে ভিড়ে নিঃসন্দেহে মিশে থাকছে সম্ভাব্য যৌন হেনস্থাকারীর দল, যারা রক্ত মাংসের নারীদেহ ছোঁয়ার বাসনা মিটিয়ে নিচ্ছে ব্রোঞ্জের মলি ম্যালোনের শরীরের উপর দিয়ে।
এমনতর ঘটনায় রীতিমত চিন্তার মুখে পড়তে হয়েছে কর্তৃপক্ষকে। ডাবলিন সিটি কাউন্সিল-এর পক্ষ থেকে জানানো হয় যে, অগণিত মানুষের হাতের ঘর্ষণে দ্রুত ক্ষয়ে যাচ্ছে মূর্তির বুকের অংশের ধাতুর আস্তরণ। ফলে প্রতি বছর নতুন পরত চাপাতে হচ্ছে তার উপর। তাছাড়া মূর্তিটির উচ্চতা সাধারণ মানুষের হাতের নাগালের মধ্যে থাকবার কারণে হাজার বারণ সত্ত্বেও ভ্রমণকারীদের সম্পূর্ণরূপে নিরস্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলত, যতদিন অবধি নতুন কোনও উপায় পাওয়া যাচ্ছে না, ততদিন রক্ষীরা চারপাশ থেকে ঘিরে থাকবে মূর্তিটি, এমন সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে কর্তৃপক্ষ।
যেন এক হৃদয়বিদারী বিমূর্ত ইন্সটলেশন। শহরের অন্যতম জনবহুল দর্শনীয় স্থানটির হৃদয়কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে এক ব্রোঞ্জের নারী, যাঁর সৃষ্টির গল্প, যাঁকে নিয়ে লেখা গান, ডাবলিনের হাওয়ায় বাতাসে ওড়ে। আর সেই মূর্তিকে ঘিরে একদল রক্ষী, যারা নিশ্চিত করবে, মূর্তিকে যেন ছুঁয়ে না যায় কোনও অযাচিত হাত। মলি ম্যালোন যদি মাছবিক্রেতা না হয়ে দেশের রানী হতেন, বা অন্য কোনও গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র, তাহলেও কি এতখানি স্পর্ধা আসত বালখিল্যতাপ্রেমী ট্যুর গাইডটির? কিংবা, মলির পোশাকটি যদি আরও বেশি ‘শোভন’ হত, ‘শালীন’ হত, তবে? নাকি সেসব কিছুতেই কিচ্ছু পালটে যেত না… এই শতকে দাঁড়িয়েও এক নারীকে ইচ্ছেমতন ছোঁয়ার জন্য এটুকু অজুহাতই যথেষ্ট হত যে সে পরিচয়গতভাবে দুর্বলতর লিঙ্গটির অধীকারী?